মাঠভর্তি সোনালী ধান, বাতাসে নতুন ধানের সুবাস আর কিষাণ-কিষাণির মুখে মুক্তোঝরা হাসি– বৈশাখের শুরুতেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরবেষ্টিত জেলা সুনামগঞ্জে গেলেই দেখা যাবে প্রকৃতির এই সুনিপুণ চিত্র।
ঝড়-বন্যার ভয় কাটিয়ে হাওরে এখন ধুম লেগেছে বোরো ধান কাটার। দম ফেলার ফুসরত নেই কৃষক পরিবারগুলোতে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত কৃষক পরিবারের সকল সদস্যই এখন ব্যস্ত। তাদের সাথে ব্যস্ত দুরদুরান্ত থেকে আসা ধানকাটা শ্রমিক, ধান কাটার যন্ত্র রিপার ও কম্বাইন্ড হারভেস্টার।
সুনামগঞ্জ জেলার ১২ টি উপজেলায় চলছে একযোগে বোরো ধান কাটা। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় জেলার ১৩৭টি হাওরে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষি বিভাগ আশা করছে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে জেলার সকল হাওরের জমির ধান কেটে গোলায় তুলতে পারবেন কিষাণ-কিষাণিরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার নলুয়া গ্রামের দেখার হাওরের কৃষক আশরাফ মিয়া বলেন, ‘আমি ধার দেনা করে এ বছর জমি চাষ করেছি অনেক ঝুকি নিয়েছি, কারণ এ বছর বাঁধের কাজ তেমন ভাল হয় নি। যদি এক নাগাড়ে বৃষ্টি বাদল থাকতও, তা হলে কৃষক পরিবারের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত।‘
তিনি বলেন, ‘আল্লাহই আমাদের রক্ষা করেন। বৃষ্টি না থাকায় বাঁধ ভাঙে নি। আমি এ বছর প্রায় বিশ কেদার জমি চাষ করেছি, ফসলও ভাল হয়েছে। খাবার ধান রেখে বিক্রিও করতে পারবও। ইতোমধ্যে আমার প্রায় ৭ থেকে ৮ কেদার জমির ধান কাটা হয়েছে, মাড়াই করে শুকাতে দিয়েছে। আরও কয়েক দিন আবহাওয়া ভাল থাকলে বৃষ্টি না হলে আমার সকল ধান তুলতে পারবও।‘
ভান্ডাবিল হাওরের কৃষক সুয়েব মিয়া জানান, ‘দুই একর বোরো জমি ধান করেছি। সামান্য কিছু কেটেছি। ফলন খুব ভাল হয়েছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে সুন্দরভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারবো।‘
ভরাম হাওরের কৃষক দীপক চন্দ্র দাস বলেন, ‘১০ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছি। এ বছর ধান পরিপক্ক (পাঁকতে) একটু সময় বেশি লেগেছে। হাওরে বোরো ফসল খুব ভাল হয়েছে। এক বিঘা জমির ধান তিনি ইতোমধ্যে কেটেছি।‘
করচার হাওরের কৃষক আসাদ মিয়া বলেন, ‘এবছর ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। আশা করি এই ধান বিক্রি করে ছেলে মেয়ে নিয়ে বছর পার করতে পারব।‘
শাল্লা উপজেলা কৃষি কমকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাসুদ (তুষার) বলেন, ‘প্রত্যেকটি হাওরেই ধান কাটা শুরু হয়েছে। এ এলাকায় বাহির থেকে ধান কাটার প্রচুর মেশিন আসতে শুরু করেছে। আসা করি ধান কাটতে কোন সমস্যা হবে না। নির্দিষ্ট সময়ে হাওর থেকে পানি পয়ঃনিষ্কাশন না হওয়া এবং সঠিক সময়ে ধান রোপন করতে না পারায় এবছর ধান পাকতে কিছু সময় ক্ষেপণ হয়েছে, তবে আপাতত বড় কোন ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা না থাকায় ভয়ের কোন কারণ নেই।‘
আগাম বন্যা ও পাহাড়ি ঢল থেকে হাওরের ফসল রক্ষায় এ বছর ৪০টি হাওরে ফসল রক্ষায় বেড়িবাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ করেছে প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জেলার ১২টি উপজেলায় মোট ৭৩৫টি প্রকল্পের অধীনে ৫৯১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে যাতে ব্যয় প্রাক্কলন ধরা আছে ১৩০ কোটি টাকা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে সুনামগঞ্জে দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করেছেন কৃষকরা। যেখান থেকে এই বছর ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২ মেট্রিক টন ধান উৎপাদিত হবে। টাকার অংকে যার বাজার মূল্য প্রায় চার হাজার একশ দশ কোটি টাকা।
জেলায় ধান কাটা ও মাড়াইয়ের জন্য ৮৫০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টর আছে। মেশিনে ৫৫ ভাগ এবং শ্রমিকেরা ৪৫ ভাগ জমির ধান কাটবেন।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, ‘ধান ঘরে তুলতে কৃষকদের সহযোগিতা ও দূর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য ইতিমধ্যে বিভিন্ন উপজেলায় জরুরি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে থেকে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।‘