সুনামগঞ্জে নির্ধারিত সময়ে বাঁধের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে শঙ্কা

দেশের সবচেয়ে বেশি হাওরবেষ্টিত এলাকা সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে ছোট বড় ১শ ৩৭ টি হাওর। শুকনো মৌসুমে যখন হাওরে পানি থাকে না ঐ সময় কৃষকরা হাওরে ধান চাষ করেন। পানি আসার আগেই কাটা হয় ধান। তবে আগাম বন্যায় অনেক সময়ই সেই ধান তলিয়ে বিপাকে পড়েন কৃষক।

তবে আগাম বন্যা থেকে ধান বা ফসল রক্ষার জন্যই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও ২০২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ। যা শেষ হবার কথা চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আর মাত্র চার দিন বাকি থাকলেও খোদ পানি উন্নয়নের বোর্ডের হিসেবে এখনও ২০ শতাংশ কাজ বাকি রয়েছে। এতে করে কৃষকরা মনে করছেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না।

এদিকে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারা ও কৃষকরা বলছেন ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে।নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনোভাবেই বাঁধের কাজ শেষ করা সম্ভব নয়।

কাজ চলছে ধীর গতিতে। কাজের ধীর গতির অজুহাত হিসেবে বলা হচ্ছে সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে। ঐ সময় লোকজন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় কাজ কিছুটা পিছিয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি’র) লোকজন এবং শ্রমিকরা নির্বাচন নিয়ে মেতে ছিল। বিগত ৭ জানুয়ারি নির্বাচন শেষ হয়ে আরও ১ মাস ২০ দিন পার হয়ে গেলেও কাজের অগ্রগতি দ্রুত করতে পারেনি সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বিগত সময়ের মতো এ বছরও বাঁধের কাজে গাফিলতির অভিযোগ তুলছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকরা। কৃষকরা বলছেন, প্রতি বছরের মতো এবারও পানি উন্নয়ন বোর্ড সময় বাড়াবে কাজ শেষ করার জন্য।

কিন্তু ইতিমধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে। ফলে ঝুঁকিতে আছে ফসল রক্ষা বাঁধ। যে বাঁধগুলো ইতিমধ্যে কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে সেগুলোতেও মাটি শক্ত করা এবং বাঁধের মাটি যাতে সরে না যায় সে জন্য ঘাস রোপনের কাজ বাকি। একারণে কয়েকটি উপজেলায় ফসল রক্ষা বাঁধে ধস দেখা দিয়েছে।

এরমধ্যে শান্তিগঞ্জ উপজেলার ছাইয়ার হাওর কিত্তার ফসল রক্ষা বাঁধ, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়া ও মইয়ার হাওরে বাঁধে দেখা দিয়েছে ফাটল। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।

তারা বলছে হঠাৎ বৃষ্টির ফলে বাঁধে সামান্য মাটি সরেছে। এগুলা দ্রুতই ঠিক করা হবে। একই সাথে আগামী চার দিনের মধ্যে ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যাবে বলে দাবি করছে তারা। সেই সাথে বাঁধের কাজেরও সময় বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না।

সুনামগঞ্জ জেলায় ইতিমধ্যে হাওরের শতভাগ জমিতে ধান রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। তাই বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় এবং বাঁধে ঘাস না দেয়ায় ফসল রক্ষা নিয়ে চিন্তা যেন শেষ হচ্ছে না।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এ বছর ২ লাখ ২৩ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করা হয়েছে। জেলার প্রায় চার লাখ কৃষকের একমাত্র বোরো ফসল অকাল বন্যার কবল থেকে রক্ষায় প্রতিবছরই ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ হয়। গণ-শুনানীর মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন শেষে এই পিআইসির মাধ্যমে কাজ করানো হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে এ বছর ১৪০০ কিলোমিটার ফসল রক্ষা বাঁধের মধ্যে ৫৮১ কিলোমিটার বাঁধে ৭৪১ টি পিআইসি’র মাধ্যমে ১২৬ কোটি টাকার মাটির কাজ করা হবে।

তবে এতে আস্থা রাখতে পারছেন না কৃষকরা। জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওরের কৃষক আব্দুল জলিল বলেন, আমরা অনেক টাকা খরচ করে ধান রোপণ করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় আমরা আতংকে ভুগছি। বাঁধ শক্ত করা জন্য দুরমুজ (চাপ দিয়ে মাটি শক্ত করা) দেয়া একই সাথে বৃষ্টির পানি যাতে সরাসরি বাঁধের মাটিতে না পড়ে সে জন্য দুর্বা ঘাস দেয়ার কথা সেটিও এখন পর্যন্ত দেয়া হয় নি। তিনি বলেন, আমাদের দাবি, যেন দ্রুত এসব কাজ শেষ করা হয়। এবার যদি আগাম বন্যায় বাঁধ ভেঙে যায় তাহলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনও পথ থাকবে না।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যে কাজ শেষ করবে। কিন্তু তারা আমাদের হিসেবে এখনও ৫০ শতাংশ কাজই শেষ করতে পারেনি। আমরা ২৮ ফেব্রুয়ারি পর জেলা ব্যাপি আন্দোলনের ডাক দিবো। এমন কি আমরা জনস্বার্থে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলাও করতে পারি। তারা কৃষকদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে।

তিনি বলেন, এই বোরো ফসল অনেক কৃষক পরিবারের সারা বছরের আয়। এই ধান বিক্রির টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে। কিন্তু অকাল বন্যায় যদি ২০১৭ ও ২০২২ সালের মতো বাঁধ ভেঙে ফসল তলিয়ে যায়, তাহলে কৃষকরা আবারও পথে বসে যাবে। তাই ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করার বিকল্প নেই।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী (১) মামুন হাওলাদার জানান, বাঁধে কোনও ধস হয় নি। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছি। সামান্য মাটি সরেছে এগুলো দ্রুত ঠিক করা হবে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮১ শতাংশ বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে। আর যেটুকু বাকি রয়েছে আশা করি সময়ের মধ্যেই কাজ সম্পন্ন করতে পারবো। বাঁধের কাজের সময় বাড়াতে হবে না। কাজ কিছুটা ধীর গতিতে হয়েছে কিন্তু এখন পুরোদমে কাজ চলছে। কোথা কোনও গাফিলতি পেলে সাথে সাথে ব্যবস্হা গ্রহণ করা হচ্ছে।