সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পরিচিত মুখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সুখ-দুঃখের সাথী ‘ট্রাম্পি’ রোববার (১৮ ডিসেম্বর) মারা গেছে। মানুষের সাথে প্রাণীর বন্ধুত্ব আর মেলবন্ধনের প্রতীক হয়ে মূর্ত হয়ে ছিল ধবধবে সাদা, শান্ত স্বভাবের এক কুকুর, যার নাম ট্রাম্পি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ক্লাসরুম, পরীক্ষার হল, আবাসিক হল কিংবা মিছিলসহ যেকোনো সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও ছাত্র আন্দোলনে ট্রাম্পির সরব উপস্থিতি ছিল বিগত ৬টি বছর। সব নিয়ম ভেঙে যেকোনো জনসমাগমে ঢুকে পড়তো ট্রাম্পি, দিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী টিলায় বসে থাকা যেকোনো নিঃসঙ্গ শিক্ষার্থীকেও সঙ্গ দিতে এগিয়ে আসত ট্রাম্পি। মানুষের সাথে এত সখ্যতা গড়ে ওঠায় ক্যাম্পাসের অন্যান্য কুকুরের সাথে ঝামেলায় জড়াতেও দেখা গেছে ট্রাম্পিকে।
সাধারণ একটি কুকুর থেকে মানুষের ভালোবাসা পেয়ে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় কুকুর হয়ে ওঠে এই ট্রাম্পি। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম তাকে নিয়ে করেছে ফিচার প্রতিবেদন।
২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্ম ট্রাম্পির। প্রতিবছর ২৮ ডিসেম্বর তার জন্মদিন পালন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে আছে ট্রাম্পির নামে একটি পেজ, যেখানে প্রতিনিয়ত দেয়া হতো তার বিভিন্ন আপডেট।
২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ এ এম এস কিবরিয়া হলে ট্রাম্পিকে লালন-পালন শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সামিউর রহমান শুভ, মো. শরিফুল আলম সুমন, রিয়াজুল ইসলাম রিয়াদ ও মো. রাজিব। ধীরে ধীরে ট্রাম্পি জায়গা করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীর মনে।
ট্রাম্পির সবচেয়ে বেশি যত্ন নিয়েছেন এবং দেখভাল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী অধিকার রক্ষা সংশ্লিষ্ট সংগঠন প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি বিনায়ক শর্মা। এছাড়া প্রাধিকার প্রায়ই ট্রাম্পির দেখাশোনা করেছে, অসুস্থতায় দিয়েছে চিকিৎসাসেবা। ট্রাম্পি ক্যানাইন ট্রান্সমিসিবল ভেনেরাল টিউমারে (সিটিভিটি) আক্রান্ত হলে তাকে কেমোথেরাপিও দেওয়া হয়েছিল। এতে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেছিল ট্রাম্পি। পরবর্তীতে আবারও প্যারাসাইটিক স্কিন ইনফেকশনে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা করে ট্রাম্পিকে সুস্থ করে তুলেছিলেন শিক্ষার্থীরা।
২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ঘোরী মো. ওয়াসিমকে বাস থেকে ফেলে হত্যার ঘটনায় সিলেট শহরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে যোগ দিয়ে প্রথম গণমাধ্যমের নজরে আসে ট্রাম্পি। এরপর তাকে নিয়ে গণমাধ্যমগুলো প্রকাশ করেছে বেশ কিছু প্রতিবেদন।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের নির্দেশে ১৮টি কুকুরকে বিষ প্রয়োগে হত্যাচেষ্টা করা হলে মৃত্যু থেকে বেঁচে এসে আবারও আলোচনায় আসে ট্রাম্পি।
শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নন, সিলেট শহর থেকে কিংবা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতিথিরা সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেই দেখা করে যেতেন ট্রাম্পির সাথে। এভাবেই মানুষের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠা ট্রাম্পির জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল।
ট্রাম্পির মৃত্যুর খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন নানা শোকবার্তা, ট্রাম্পির সাথে তাদের নানা অভিজ্ঞতা ও সম্পর্কের কথা।
শিক্ষার্থী মো. জয়নাল আবেদীন লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আনাচে-কানাচে ট্রাম্পির চলাফেরা ছিল। প্রত্যেকটা মানুষের তাকে নিয়ে এক ধরণের আবেগ জড়িয়ে আছে।’
আরেক শিক্ষার্থী লিমন হাসান লিখেছেন, ‘ট্রাম্পি মারা গেছে। তার সাথে সখ্যতা ছিল না এমন মানুষ ক্যাম্পাসে কমই আছে। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে হলের ছাদ সব জায়গায় ছিল তার বিচরণ। ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে বন্ধুরা ঘুরতে এলে ট্রাম্পিকে ডেকে তার গল্পটা হয়তো আর বলা হবে না।’
ফারদিন শাহরিয়ার লিখেছেন, ‘ট্রাম্পি আর আমাদের মাঝে নেই এটা ভাবতেই কষ্ট লাগছে।’
অসীম কুমার বৈষ্ণব লিখেছেন, ‘ট্রাম্পি শুধু কুকুর ছিল না, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা মানুষের ভালো বন্ধুও বটে।’
সানজিদা আরেফিন কথা লিখেছেন, ‘সবার প্রিয় ছিল সে’ ক্যাম্পাসে আমরা আর ট্রাম্পি একই সাথে বেড়ে উঠলাম। আমরা রয়ে গেলাম, সে চলে গেল।’
আব্দুল্লাহ আল মামুন লিখেছেন, ‘ট্রাম্পিই একমাত্র ছাত্র যে কি না ক্যাম্পাসের সকল অনুষদে ক্লাস করেছে। ছাত্র আন্দোলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, জন্মদিন পালন, ক্লাসরুম, ট্যুর, রেস্টুরেন্ট খেতে যাওয়া, বিভিন্ন সংগঠনের মিটিং থেকে শুরু করে সকল আয়োজনে সে উপস্থিত হয়ে সকলের সাথে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করত। সকলের আনন্দে যেমন আনন্দিত হতো, তেমনি সকলের দুঃখে দুঃখিত হতো। মসজিদে দোয়ার সময় সে বাইরে মাটিতে মাথা নুইয়ে দোয়া করতো। ট্রাম্পি তার ছোট এ জীবনে রেখে গেল হাজারও স্মৃতি। জয় করল হাজারও মানুষের হৃদয়।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুচকা চত্বরে শেষকৃত্য শেষে ট্রাম্পির নিথর দেহকে কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামের পাশে শায়িত করেছেন শিক্ষার্থীরা।