দারিদ্র্যের কষাঘাতে দিন কাটাচ্ছেন উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। নদীভাঙনে বাস্তুভিটা ও আবাদি জমি হারানোসহ নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে হাঁপিয়ে উঠেছেন তারা। এ অবস্থায় জীবিকার রসদ জোগাতে বাধ্য হয়ে পরিবারের শিশু সদস্যদেরও শ্রম বিক্রিসহ উপার্জনে নামাতে বাধ্য হচ্ছেন অভিভাবকরা। জেলার ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার চরাঞ্চল ঘুরে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জেলার উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের কড্ডারমোড় (মোল্লারহাট) বাজারে একটি চায়ের দোকানে হাবিবুর, আমির হোসেন ও শহিদুল নামে তিন শিশুর দেখা মেলে। এদের মধ্যে হাবিবুর ও আমির হোসেন তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিন জন মিলেই দোকানে আগন্তুক ভোক্তাদের খাবার সরবরাহ করছিল।
কথা বলে জানা যায়, কাজের প্রয়োজনে এরা স্কুল ছেড়েছে। এদের মধ্যে হাবিবুরের (৯) বাড়ি ছিল ওই ইউনিয়নের বালাডোবার চরে। সে খুদিরকুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছে। কিন্তু নদী ভাঙনে ভিটে হারিয়ে তারা এখন রসুলপুর গ্রামে স্থানান্তরিত হয়েছে। হাবিবুরের আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে হাবিবুর এখন হোটেল শ্রমিকের কাজ করে। তার দৈনিক মজুরি দেড়শ’ টাকা।
হাবিবুরের ভাষ্য, ‘বাড়ি নদী খায়া ফেলাইছে। অহন রসুলপুরে থাহি। বাবা বাইরে তাঁতের কাজ করেন। আমি মা-বোনসহ থাহি। কাজ না করলে খামু কি? এজন্য দোহানে কাজ করি। দিন শ্যাষে ট্যাহা নিয়া মাক দেই।’
হেসে খেলে স্কুলে পড়ার বয়সে ছেলে হোটেল শ্রমিক কেন, জানতে চাইলে হাবিবুরের মা হাজেরা বলেন, ‘সংসারে অভাব। ছেলে পড়াশোনা করতে চায় না। এ জন্য কামে দিছি।’
হাটের দিনে মোল্লারহাট বাজারে শাক বিক্রি করছিল সুমন (১৩)। বেগমগঞ্জের ইসলামপুর গ্রামের দিনমজুর সফিকুলের ছেলে সে। ২০২১ সালে চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। সংসারের অভাব সফিকুলের শিক্ষাজীবনকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে দেয়নি।
‘সংসারে অভাব। স্কুল ছাইড়া ইটভাটায় কাজ নিছিলাম। অহন ভাটাও নাই। বাড়িত থাকি সংসারের কাজত সাহায্য করি,’ ক্ষেতের শাক বাজারে বিক্রি করতে এসে এভাবেই নিজের কথা জানায় সুমন।
সদরের যাত্রাপুর আর উলিপুরের বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের একাধিক চরে ঘুরে জানা যায়, ভাঙন কবলিত এসব চরের বাসিন্দারা ঘরবাড়ি সরিয়ে নিলেও অর্থ সংকটে তা এখনও মেরামত করতে পারছেন না। চরের আবাদি জমিগুলোর অধিকাংশ ভাঙনে বিলীন হওয়ায় সেখানে মৌসুমি সবজির তেমন আবাদ নেই। আমন আবাদও উল্লেখযোগ্য হয়নি।
এলাকায় কাজ না থাকায় বেশিরভাগ পরিবারের পুরুষ সদস্যদের উপার্জন নেই। অনেকে পরিবার খাদ্যের সংস্থান করতে সুদের ওপর ঋণ নিয়েছেন। অনেকে অর্থের জোগান দিতে পরিবারের শিশুদের স্কুলের না পাঠিয়ে কাজে দিয়েছেন। এদের কেউ সস্তায় শ্রম বিক্রি করছে, আবার কেউ ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়েছে।
স্কুলে ফেরা হবে কিনা তার উত্তর জানে না কেউ। কাজের অভাব, কমেছে ক্রয় ক্ষমতা জেলায় কাজের অভাবে সাধারণ মানুষের উপার্জন কমেছে। আর এতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতাও কমেছে। বেগমগঞ্জের মুসার চরের মঞ্জু মিয়া বলেন, ‘সবকিছুর দাম
বাড়ছে, নৌকার ভাড়াও বাড়ছে। কিন্তু কামাইতো বাড়ে নাই। অহন কামের অভাবে বেকার হইয়া আছি।’
একই চরের বাসিন্দা গৃহবধূ আহিরণ বলেন, ‘বছরেও গরুর গোশতো জোটে না। ব্রয়লার খাইতাম, অহন তার দামও বাড়ছে। নদীত মাছ পাইলে খাই, না হইলে তাও জোটে না। কিইনা (কিনে) খাওনের ট্যাহা কই?’
পুরুষদের উপার্জনের প্রসঙ্গে আহিরণ বলেন, ‘যতদিনে ধান পাকবো, আলু লাগানোর সময় আইবো ততদিনে কাম জুটবো। অহনতো কোনও কাম নাই, সুদের উপর ট্যাহা নিয়া সংসার চলতাছে।’
মানুষের ক্রয় ক্ষমতার চিত্র ফুটে ওঠে মোল্লারহাট বাজারের ভ্রাম্যমাণ তেল বিক্রেতা রূপ চাঁদের ভাষ্যে। তিনি বলেন, ‘মাইনষের ট্যাহা নাই। জমিজমা ভাঙছে। মানুষ জিনিসপত্র কিনবো কী দিয়া? দুই হাটে ২৫ লিটার ত্যালও বেচি হয় না! বেশিরভাগ মানুষ আধা পোয়া করি ত্যাল কেনে।’
কাজের অভাব এবং মানুষের উপার্জন কমার বিষয়ে বেগমগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবলু মিয়া বলেন, ‘এলাকায় কোনও কাজ নেই। নদীতে মাছও পাওয়া যায় না। মানুষ কর্মহীন হয়ে আছে। ইউপিতে তাদের জন্য কোনও প্রকল্পও নেই।’
‘গত পাঁচ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বেশি অভাব। এই সময়ে নদী ভাঙনে প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার আবাদি জমি বিলীন ও এক হাজার পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। কিন্তু পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মানুষ খুব কষ্টে আছে,’ যোগ করেন চেয়ারম্যান। জেলা প্রশাসনের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার তথ্যমতে, গত বছর নদী ভাঙনের শিকার হয়ে জেলায় অন্তত ৩৬৪ পরিবার বাস্তুহারা হয়েছে। এ বছর এখন পর্যন্ত পাওয়া তিন উপজেলার তথ্য অনুযায়ী ৬০৭টি পরিবার বাস্তুভিটা হারিয়েছে। এরমধ্যে উলিপুর উপজেলাতে ৩২৫ এবং সদর উপজেলায় ২১০ পরিবার বাস্তুভিটা হারিয়েছে। এদের পুনর্বাসনে এখনও কোনও বরাদ্দ পাওয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের খানার আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বসবাস কুড়িগ্রামে। এ জেলার রাজীবপুর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, শতকরা ৭৯ দশমিক ৮ ভাগ। এর পরেই রয়েছে জেলার রৌমারী উপজেলায় ৭৬ দশমিক ৪ ভাগ। জেলার সদর উপজেলাতে শতকরা ৭২ দশমিক ৬ ভাগ মানুষ দরিদ্র। এই তালিকায় থাকা প্রথম ১১টির মধ্যে কুড়িগ্রামেরই ৯ উপজেলা। বাকি দুটি হলো বান্দরবানের থানচি এবং দিনাজপুরের খানসামা উপজেলা।
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন