লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের হাতে বন্দী সুনামগঞ্জের তিন যুবক

লিবিয়ায় মাফিয়া চক্রের হাতে বন্দী সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার তিন যুবক। অত্যাচারের ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে ৫১ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে চক্রটি।

জানা গেছে, স্বপ্নের দেশ ইতালি যাবার আশায় লেখাপড়া ছেড়ে দালালের প্ররোচনায় লিবিয়ায় পাড়ি জমান সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজারের তিন যুবক। তবে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের হাতে পড়ে সে স্বপ্ন এখন ফিকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিও ও স্থিরচিত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে লিবিয়ার আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের হাতে বন্দি রয়েছেন এই তিন যুবক। হাতেপায়ে শিকল পড়িয়ে বেধড়ক মারধর করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানব পাচারকারীদের হাতে বন্দী এই তিন যুবক হলেন- দোয়ারাবাজার উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের ভিখারগাঁও গ্রামের আব্দুস সাত্তারের পুত্র সুমন মিয়া (২২), কুশিউড়া গ্রামের ইউসুফ আলীর পুত্র নোমান মিয়া (২৪), চনোগাঁও গ্রামের কোরবান আলীর পুত্র সৌরভ আহমেদ(২৪)।

ছেলের কান্নাকাটি আর মারধরের ছবি দেখে এখন শোকের মাতম বইছে তিন পরিবারের মধ্যে।

বন্দী তিন যুবকের পরিবারের কাছ থেকে জানা যায়, গত বছরের অক্টোবর থেকে লিবিয়া থাকতেন তারা। একপর্যায়ে একই ইউনিয়নের বরখাল গ্রামের আব্দুল বারেক তাদের ইতালি নেয়ার প্রস্তাব দেয়। তিন যুবককে লিবিয়া থেকে ইতালি পর্যন্ত পৌছে দেয়া হবে এমন চুক্তি হয় আব্দুল বারেকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম ও পুত্র রেজাউল করিমের সাথে।

বারেকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম, পুত্র রেজাউল করিম ও শ্যালক আব্দুল হামিদ তাদের কাছে তিনজনের পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা করে নেন ইতালি যাবার খরচ হিসেবে। এর কিছুদিন পরই বারেকের পরিবারের লোকজন জানান ওই তিন যুবক লিবিয়ায় মাফিয়ার হাতে আটক হয়েছে। সাড়ে সাত লক্ষ টাকায় তাদের ইতালি পাঠানো সম্ভব হবে না। মাফিয়ার হাত থেকে ছাড়ানোসহ আর তিন লক্ষ টাকা করে প্রত্যককে দিতে হবে। পরে তারা গত ৩ এপ্রিল আব্দুল বারেকের স্ত্রী রেজিয়া খাতুনের সাথে কথা বলে প্রত্যেক পরিবারের লোকজন তিন শত টাকা মূল্যের স্টাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করে প্রত্যকে তিন লক্ষ টাকা জমা করেন বারেকের স্ত্রীর হাতে। দুই মাস অতিবাহিত হলেও তাদের তিনজনকে ছাড়িয়ে আনেননি আব্দুল বারেক। এখন অতিরিক্ত আরো ৭ লক্ষ টাকা করে দাবি করছেন তারা।

আরও পড়ুন : শাল্লায় ২০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে ‘স্মার্ট ওয়ার্ক কোম্পানি’ উধাও!

ভিখারগাঁও গ্রামের বন্ধিদশায় থাকা সুমনের ভাই সেলিম আহমদ জানান, ‘আমার ভাই সুমনকে বড়খাল গ্রামের আব্দুল বারেক লিবিয়া নেন। ইতালি পর্যন্ত সাড়ে সাত লক্ষ টাকায় চুক্তি ছিল। প্রথমে লিবিয়া পাঠাই ৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকায়। লিবিয়া থেকে ইতালি পাঠাতে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা লাগবে বলে জানান আব্দুল বারেক। তাদের কথামত আমরা সাড়ে সাত লক্ষ টাকা দেই। এর ১৫ /২০ দিন পরে আব্দুল বারেক তার স্ত্রীকে জানান, আমার ভাইকে মাফিয়া চক্র বন্দী করেছে। এখন তাকে মাফিয়ার হাত থেকে ছাড়িয়ে এই সাড়ে সাত লক্ষ টাকায় ইতালি পাঠানো সম্ভব হবে না। বারেকের স্ত্রী ও পুত্র রেজাউল করিমের হাতে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা জমা দেয়ার কিছু দিন পরে তাদের মোবাইল থেকে কল দিয়ে আমার ভাইয়ের কান্নাকাটি চিৎকারের আওয়াজ শুনিয়ে আরো তিন লক্ষ টাকা দাবি করেন। আমরা নিরুপায় হয়ে ভাইকে বাঁচাতে ধার-দেনা, জমি জমা বন্ধক দিয়ে তিন লক্ষ টাকা যোগাড় করি। পরে এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে স্টাম্পের মাধ্যমে চুক্তি করে তিন লক্ষ টাকা জমা করি বারেকে স্ত্রী রাজিয়া বেগমের কাছে। এর সপ্তাহ খানেক পরে বারেকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম জানান মাফিয়াদের খাবারের বিল ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে, না হয় তাদের আর খাবার দাবার দিবে না। তখন আরও ৫০ হাজার টাকা জমা দেই বারেকের স্ত্রীর কাছে। কয়েকদিন পরে বারেকের শালা ডালিয়া গ্রামের আব্দুল জলিলের পুত্র আব্দুল হামিদ জানান, সুমন অসুস্থ তাকে বাঁচাতে হলে এক লক্ষ টাকা পাঠাতে হবে, আমি তার কাছে ৮০ হাজার টাকা দেই। সব মিলে আমার কাছ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। এখন আমার ভাইকে বেধড়ক মারপিট করছে আর আমার কাছে এসব ছবি পাঠিয়ে আরো দুই লক্ষ টাকা দাবি করছে। আমরা এখন নিরুপায় হয়ে গেছি, এই দিকে বারেকের মোবাইল ফোনেও যোগাযোগ করতে পারছি না। বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের লোকজনদেরও পাচ্ছি না।’

তবে অভিযুক্ত আব্দুল বারেকের স্ত্রী রাজিয়া বেগম জানান, ‘আমার কাছে তিন জনের ২৯ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা জমা দিয়েছে। আমার স্বামীর সাথে এক সপ্তাহ যাবৎ যোগাযোগ করতে পারছি না। আমিও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের ছাড়িয়ে আনার জন্য।’

আরও পড়ুন : কানাইঘাটজুড়ে গুটিবসন্ত, মারা গেছে কয়েক’শ গরু

এ ব্যাপারে দোয়ারাবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ দেব দুলাল ধর জানান, ‘আমরা ফেসবুকের মাধ্যমে খবর পাই। এরপর তিন পরিবারের লোকজনকে থানায় আসার জন্য ডাকা হয়। তাদের সাথে পরামর্শ করি কিভাবে মাফিয়ার হাতে আটক তিনজনকে ছাড়িয়ে আনা যায়। আব্দুল বারেকের পরিবারের লোকজন বাড়িতে নাই। বাড়িতে থাকলে বারেকের সাথে যোগাযোগের ব্যাবস্থা করা যেত।’