বঙ্গবন্ধু যেভাবে ‘রাজনীতির কবি’

‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে- কখন আসবে কবি?’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ ছিল পাকিস্তানি শোষণ থেকে রেহাই পেতে চাওয়া বাঙ্গালি মুক্তিকামী জনতার জন্য একটি অনিবার্য এবং অকাট্য নির্দেশনা।

তারপর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার পরপরই কারাবন্দী হন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় বাঙালির দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের শেষ ধাপ—মুক্তিযুদ্ধ।

মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভিক সময়ে আজকের এই দিনে (৫ এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’ তাদের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুদ্ধ নিয়ে। প্রচ্ছদে ছবি ছাপা হয় বঙ্গবন্ধুর।

আর এই প্রতিবেদনেই বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয় ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে।

সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন নিউজউইক ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে ইংরেজি ভাষায় এটির চারটি মুদ্রণ ও বিশ্বজুড়ে আরো ১২টি মুদ্রণ হত।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল এক অনবদ্য কবিতা আর তিনিই সেই কাব্যের মহাকবি। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।

৭ মার্চ যারা রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মতে, সেই জ্বালাময়ী ভাষণ কোনো ভাষণ নয় বরং একজন সুনিপুণ কবির ছন্দময় কবিতা। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তাঁর এই ভাষণের একটি লিখিত ভাষ্য অচিরেই বিতরণ করা হয়েছিল যা মোট ১২টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়।

কবি কল্পনা করেন, স্বপ্ন দেখেন। সেই স্বপ্নের প্রতিরূপ ফুটে উঠে তাঁর কবিতায়। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন রাজনীতি নিয়ে, সেই স্বপ্ন ছিল একটি জনগোষ্ঠীকে মুক্তি দেওয়ার; একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র উপহার দেয়ার। কবিদের মতোই বঙ্গবন্ধু রূপ দিয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের।

বঙ্গবন্ধু রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে ‘থালা বাটি কম্বল/জেলখানার সম্বল’ লেখাটি থেকে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ রচনাসমূহ যে কত গভীর ও বিশাল কবিতার প্রতীক, তা সহজেই অনুমান করা যায়।

বঙ্গবন্ধু তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, ‘জেলে যারা যায় নাই, জেল যারা খাটে নাই- তারা জানে না জেল কী জিনিস! আমি পাঁচবার জেলে যেতে বাধ্য হয়েছি। রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছি, সশ্রম কারাদন্ডও ভোগ করতে হয়েছে। আবার হাজতি হিসেবেও জেল খাটতে হয়েছে। তাই সকল রকম কয়েদির অবস্থা নিজের জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছি।’

১৯৭১ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালিদের দেখিয়েছিলেন মুক্তির দিশা। মহাত্মা গান্ধী, জর্জ ওয়াশিংটন, মাও সেতুং, হো-চি মিন, ফিদেল কাস্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, লেনিন, মার্শাল টিটোর মতো বঙ্গবন্ধুও তাঁর অসামান্য দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের চিরঞ্জীব উদাহরণের জন্য বিশ্ব-ইতিহাসের অনিবার্য ও অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

রাজনীতির এই কবিকে নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ এবং বিদেশের লেখক অজস্র গল্প, গান, কবিতা, নাটক রচনা করেছেন যা নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের খুব কম রাষ্ট্রনায়ক ও রূপকারকে নিয়ে লেখা হয়েছে। অগ্রজ কবিদের লেখনী থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমকালীন কবিরা যেমন লিখছেন, আগামী দিনের কবিরাও তেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের কবিতায় চিত্রিত করবেন নানাভাবে, নানারঙে।

“অত:পর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন৷
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা৷ কে রোধে তাঁহার বজ্রকন্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম৷’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের৷”