জৈন্তাপুরে আশ্রয়ণের ঘর ভাড়া দিয়ে সুবিধাভোগীরা বাড়িতে

এক বছর আগে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পের বরাদ্দ করা অনেক ঘরে এখনও ঝুলছে তালা। কেউ কেউ বরাদ্দকৃত ঘর ভাড়া দিয়ে থাকেন নিজ বাড়িতে। কারও কর্মক্ষেত্র দূরে ও আশেপাশে কোনো কর্মক্ষেত্র না থাকায় ঘর ছেড়ে চলে গেছেন। অনেকে আবার ঘর হাতছাড়া না করতে স্বজনদের বসিয়ে রেখে নিজে থাকেন শহরে বাসা ভাড়া করে।

সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায় মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে আশ্রায়ন প্রকল্পে ভূমিহীন ও গৃহহীন জন্য বরাদ্দ করা ৩৬০ ঘরের চিত্র এটি। অবশ্য কয়েকটি ঘরে উপকারভোগীরা বসবাস করছেন। তবে সীমানা নির্ধারণ না করা ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে বেশ ভোগান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে তাদের।

স্থানীয়রা বলছেন, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের গাফিলতি, স্বজনপ্রীতি, প্রকৃত ভূমিহীন-গৃহহীনদের বাছাই করতে না পারার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

অবশ্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসন বলছে, বিষয়টি তাদের জানা নেই। দ্রুত পরিদর্শন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে জৈন্তাপুর উপজেলায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় চার ধাপে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৩৬০টি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০২৩ সালের ২২ মার্চ গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে জৈন্তাপুর উপজেলাকে ভূমিহীন ও গৃহহীন (ক-শ্রেণি) মুক্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদিন বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগীর হাতে ঘরের চাবি হস্তান্তর করা হয়।

তবে প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণার এক বছর পার হলেও এখনও আশ্রয়ণ প্রকল্পের অনেক ঘরে তালা ঝুলছে। অনেক পরিবারকে ঘরের চাবি ও জমির কাগজপত্র বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। এ নিয়ে উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের কাছে ধরণা দিয়েও সুরাহা হয়নি।

কেউ কেউ বরাদ্দ করা ঘর ভাড়া দিয়ে থাকেন নিজের বাড়িতে। কেউ ঘরে তালা দিয়ে থাকেন অন্যত্র। এমনকি বরাদ্দ করা ঘরের এক উপকারভোগী সরকারি চাকরি করেন। চাকরির সুবাদে তিনিও থাকেন উপজেলা শহরে। এমন যাচ্ছেতাই অবস্থা সরকারের এ প্রকল্পে।

সম্প্রতি জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি এবং চারিকাটা ইউনিয়নের বাউরভাগ দক্ষিণ (বনপাড়া) গ্রামে মুজিববর্ষের আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর ঘুরে দেখা গেছে, উপকারভোগী অনেকের কাছে জমির দলিল ও ঘরের চাবি হস্তান্তর না করায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারছেন না। নলকূপের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় পানির অভাবে ও অসম্পূর্ণ নলকূপের গর্তে পড়ে দুর্ঘটনার ভয়ে সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে কয়েকটি পরিবার। তাছাড়া ঘরের সীমানা নির্ধারণ না থাকায় ঝগড়া-বিবাদ জড়াতে হচ্ছে অনেককে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার নিজপাট ইউনিয়নের গোয়াবাড়ি এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৭৪ নম্বর ভাড়া দিয়েছেন উপকারভোগী। এ ঘরে এ তার এক নিকট আত্মীয় বাস করেন। একইভাবে ৯০ নম্বর ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ৯৮, ১০৬ ও ১১৫ নম্বর ঘরে একদিনও পা পড়েনি সুবিধাভোগীর। তাদের নিজেদের বাড়িঘর রয়েছে বলে জানা গেছে।

এছাড়াও ১০৭ নম্বর ঘরের উপকারভোগী জৈন্তাপুর উপজেলায় একটি সরকারি অফিসে চাকরি করেন। তার এক নিকট আত্মীয় এই ঘরে ভাড়া থাকেন। ১২৬ নম্বর ঘরের উপকারভোগী ঢাকায় বাস করেন। তার ঘরও একজনের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ২২৮ নম্বর ঘরের উপকারভোগী সিলেট শহরে বাসাভাড়া করে থাকেন। এ ঘরও দীর্ঘদিন ধরে খালি অবস্থায় পড়ে আছে।

তাছাড়া ৭৬, ৮৯, ১১৪, ১২১, ১৯৫, ২০১, ২০৩, ২১৫, ২১৬, ২১৭, ২১৯, ২২০, ২২৩, ২২৫, ২২৬, ২২৭, ২৩০, ২৩৩, ২৩৫, ২৩৯, ২৪০, ২৪৩, ২৪৪, ২৪৬, ২৫১, ২৫২, ২৫৪, ২৫৫, ২৫৬, ২৫৯, ২৬৪, ২৬৫, ২৬৬, ২৭১, ২৭৪, ২৮১, ২৮২, ২৮৩, ২৮৫, ২৮৬, ২৮৭, ২৮৮, ২৯৪, ২৯৫, ২৯৯, ৩০৬ ও ২২৪ নম্বর ঘর যাদের নামে বরাদ্দ করা হয়েছে তাদের কেউ এখানে থাকেন না। কেউ কেউ এসব ঘর বিক্রি করে দেওয়ার খবরও পাওয়া গেছে। কেউ পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকেন।

আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগী একাধিক পরিবারের সদস্যরা বলেন, বেশিরভাগ নলকূপ এখনও স্থাপন করা হয়নি। বিশুদ্ধ পানির খুবই সংকট। তাছাড়া ঘরের সীমানা নির্ধারণ করা হয়নি। এসব কারণে প্রতিনিয়ত নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এতে করে এখানে বসবাসের প্রতি মানুষের অনীহা তৈরি হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, এ প্রকল্পের ঘর বরাদ্দের সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে উপকারভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়া সঠিকভাবে হয়নি। যার কারণে সরকারের এ প্রকল্প ভেস্তে গেছে। প্রকৃত ভূমিহীন ও গৃহহীনরা এখনও খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।

এ বিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, তিনি উপজেলায় নতুন যোগদান করেছেন। তাঁর যোগদানের পূর্বে ঘরগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি ঘরগুলো পরিদর্শন করবেন বলে জানান।

এ বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনে পরিদর্শন করে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।