রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো বৃহস্পতিবার (২৫ আগস্ট)। এই পাঁচ বছরে মানবিক আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে ইয়াবা, মানবপাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। শিবিরের অভ্যন্তরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আধিপত্য বিস্তারে বাড়ছে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা। চলছে অস্ত্রের মহড়া, ঘটছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড।
পুলিশ বলছে, হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানবপাচার ও আধিপত্য বিস্তারসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিছু রোহিঙ্গা।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রত্যাবাসন ছাড়া রোহিঙ্গাদের অপরাধী কার্যক্রম থেকে মুক্তির উপায় নেই। তবে পরিকল্পিত ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা কমানো সম্ভব।
আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের তথ্যমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত চার মাসে ১২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মো. ইব্রাহীম (৩০) নামে এক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হন হাবিব উল্লাহ (২০) নামে এক রোহিঙ্গা। ৪ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ১ আগস্ট বিকালে উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নুরুল আমিন (২৬) নামে এক রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে মো. সলিমুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)। এসব ঘটনায় ৯টি মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধের কথা তুলে ধরে কক্সবাজার জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২০ আগস্ট পর্যন্ত মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪৩৮টি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজার ২২৬ জন। এর মধ্যে অস্ত্র মামলা ১৮৫টি, মাদক মামলা এক হাজার ৬৩৬টি, ধর্ষণ মামলা ৮৮টি, হত্যা মামলা ১১৫টি, অপহরণ ও মুক্তিপণ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩৯টি। তবে অন্যান্য সময়ের তুলনায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য। এরপরও অপরাধ কমছে না তাদের।’
প্রসঙ্গত, রাখাইন রাজ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তল্লাশিচৌকিতে হামলার অভিযোগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন শুরু করে। এ সময় গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। তাদের নির্যাতনের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে রোহিঙ্গারা। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখ ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেন। গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বেড়েছে আরও দেড় লাখের বেশি।
শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকার এবং জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন অফিস ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের অসহযোগিতা ও কূটনৈতিক নানা কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি।