আবহমান বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি পৌষ সংক্রান্তি

দেখতে দেখতে পৌষ বিদায় নিলো। আর পৌষের শেষ দিন মানেই বাঙালীর ঐতিহ্যবাহী পৌষ সংক্রান্তি। গতকাল রোববার ছিল পৌষ মাসের শেষ দিন। তাপমাত্রার পারদ কিছুটা বাড়লেও শীতের দাপট নিয়েই মাঘের শুরু হয়েছে।

পৌষ সংক্রান্তি বাঙালীর প্রাচীন উৎসবগুলোর মধ্যে একটি। এক সময় বেশ ঘটা করে উদযাপন করা হতো সংক্রান্তি। বিশেষ করে গ্রাম বাংলায় এ উপলক্ষে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান পালনের রীতি প্রচলিত ছিল। এখন যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে এমন নয়। বরং ঐতিহ্যপ্রেমী শহুরে মানুষও উদযাপন করে পৌষ সংক্রান্তি।

পৌষ সংক্রান্তিকে পৌষ পার্বণ বা মকর সংক্রান্তিও বলা হয়ে থাকে। এটি মূলত জ্যোতিষ শাস্ত্রের একটি ক্ষণ। মকর সংক্রান্তি বলতে, নিজ কক্ষপথ থেকে সূর্যের মকর রাশিতে প্রবেশের ক্ষণটিকে ইঙ্গিত করা হয়।

পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা-পুলির আয়োজন করা হয়। বছরের বিভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত পিঠা উৎসবের মধ্যে পৌষ সংক্রান্তি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছে। লোকজ সংস্কৃতির গবেষকদের মতে, মকর সংক্রান্তি বা উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পিতৃপুরুষ ও বাস্তুদেবতার জন্য তিল কিংবা খেজুর গুড় দিয়ে তিলুয়া তৈরি করত। নতুন চালে তৈরি করা পিঠার অর্ঘ্য দান করত। এ কারণে পৌষ সংক্রান্তির আরেক নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠা সংক্রান্তি।

এ দিন বিভিন্ন অঞ্চলে শিশু-কিশোররা বাস্তুর গান, কুলাইর ছড়া, হোলবোলের গান, বাঘাইর বয়াত গেয়ে চাল ও অর্থ সংগ্রহ করে পৌষপালা, বনভোজন ইত্যাদির আয়োজন করে। একই দিন দধি সংক্রান্তির ব্রতের শুরু হয়। এই ব্রতে প্রতি সংক্রান্তিতে লক্ষ্মীনারায়ণকে দধি দ্বারা স্নান করিয়ে ব্রাহ্মণকে দধি ও ভোজদান করা হয়। তাই বলে পৌষ সংক্রান্তিকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার বিশেষ সুযোগ নেই। লেখক যতীন সরকারের মতে, কারও কারও মনে হতে পারে পৌষ সংক্রান্তি ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বৈ কিছু নয়। বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন।

আবহমান কাল থেকেই বাংলায় ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ নীতি চলমান। ফলে পৌষ সংক্রান্তিও বাঙালীর প্রতি ঘরে উদযাপিত হয়ে আসছে। অবশ্য এখন অনেক কিছুই আগের মতো নেই; হয় না। এভাবে স্বতন্ত্র মাত্রা পায় পৌষ সংক্রান্তি। অনেকে আবার পৌষের শেষ দিনটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান না। বরং পুরো পৌষ জুড়েই নানা উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন চলে।

এ সময় গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হয় ভাপা, পাটিশাপটা, সন্দেশ, দুধ চিতই, মুগ পুলি, ছিট পিঠা। মা, মেয়েরা রাত জেগে পিঠার গায়ে অলঙ্করণ করেন। ফুল লতাপাতা, পাখি, মাছের চোখ আঁকেন। এভাবে গোটা রাত পার হয়ে যায়। একদিকে চুলো থেকে পিঠা ওঠে। অন্য দিকে চলে গরম গরম খাওয়া। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদেরও নিমন্ত্রণ করে বাড়ি এনে পিঠা খাওয়ানো হয়।

বাংলা এই মাসের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী আয়োজন পৌষমেলা। রবীন্দ্রনাথ শান্তি নিকেতনে পৌষমেলার আয়োজন করতেন। এখনও পৌষমেলায় লোকজ সংস্কৃতির নানা পণ্য দিয়ে স্টল সাজান দোকানিরা। রাখা হয় পিঠা, পায়েস, খেজুরের রস।

রাজধানীতে সংস্কৃতিকর্মীরা একটি বড়সড় পৌষমেলার আয়োজন করে থাকে। মেলায় যথারীতি থাকে পিঠা-পুলি। বেশ কিছু স্টল বসে। সকলের চোখের সামনেই চলে পিঠা তৈরির কাজ। চাইলেই কিনে খাওয়া যায়। একই সময় লোক আয়োজন থাকে অনুষ্ঠান মঞ্চে। মঞ্চ থেকে জারি, সারি, ভাটিয়ালী গানে তুলে ধরা লোকায়ত সংস্কৃতি। পুঁথি পাঠ, নৃত্য, নাটকের ভাষায় শহুরে প্রজন্মকে আহ্বান জানানো হয় মাটির কাছাকাছি আসার।