সিলেটে প্রথমবারের মত জমকালো আয়োজনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মরমী কবি ও সাধক হাছন উৎসব। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) মরমী সাধক হাছন রাজার গান শুনতে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আগমন ঘটে হাজার হাজার ভক্তদের। একের পর এক বাউল শিল্পীরা গাইতে থাকেন হাসন রাজার কালজয়ী সব গান।
হাছন রাজার মরমী সাধনা বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে সঙ্গীতের যে অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছে সেই ধারাকে সমুন্নত রাখতে এই উৎসবের আয়োজন বলে জানিয়েছেন আয়োজকেরা।
সিলেটের বাউল বিরহী কালা মিয়া জানান, হাছন রাজাকে এবং তাঁর মরমী সাধনাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এবারই প্রথমবারের মত সিলেট শহরে উদযাপিত হচ্ছে হাছন উৎসব-২০২৪।
তিনি জানান, ১৯৬৩ সালে সুনামগঞ্জ জেলায় হাছন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ১৯৭৪ এবং ১৯৭৫ সালেও সেখানে হাছন উৎসব হয়েছে। তবে এত বছর পর মরমী কবির এবারের উৎসবটি সর্ববৃহৎ। এই উৎসবের মাধ্যমে হাছন রাজার সাধক জীবন, কর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার পাশাপাশি সুফিবাদের চেতনা সমুন্নত হবে বলে আশাবাদী৷
দুই দিনব্যাপী হাছন উৎসব-২০২৪ উদযাপন কমিটির প্রচার সম্পাদক এম এস এ মাসুম খান প্রচার বলেন, ‘শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে মরমী সাধক হাছন রাজা লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদের আয়োজনে আমরা হাছন উৎসব করতে পারছি।’
তিনি বলেন, ‘আগামীকাল কবি কাজী নজরুল অডিটোরিয়ামেও উৎসবের দ্বিতীয় দিনের আয়োজন। আশা করব সিলেটের সংস্কৃতিবান্ধব সর্বস্তরের মানুষজন আজকের মত এই অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকবেন এবং হাছন উৎসব উপভোগ করবেন।’
বাউল সূর্য লাল দাস বলেন, ‘বিভাগীয় পর্যায়ে এত বড় হাছন উৎসব আর আগে কখনো হয়নি। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। যারা এই অনুষ্ঠানকে সাফল্যমণ্ডিত করতে কাজ করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাছন রাজা সত্যিকার একজন মরমী সাধক। তাঁর গান নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরও। এমনকি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর গানের প্রশংসা করেছেন৷ হাছন রাজার মত এত বড় দার্শনিক ও সাধক আগামীতে এই মাটিতে জন্ম হবে কি না জানা নেই। তবে তাঁর যে অবদান সেটি যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে চির অমর হয়ে থাকবে।’
হাছন উৎসব উদযাপন কমিটির আহবায়ক ডা. জহিরুল ইসলাম অচিনপুরী সিলেট ভয়েসকে বলেন, ‘আমি আনন্দিত এজন্য যে, হাছন রাজা কী মাপের মরমী সাধক- আমরা সিলেটিরা তার মাপটাকেই বুঝতে পারিনি। একটি বড় গাছকে যেমন ঘিরে ধরা যায় না, হাছন রাজাও তেমনি বড় মাপের এক সাধক- যাকে ঘিরে ধরা যায় না।’
অচিনপুরী বলেন, ‘তিনি যে মাপের আধ্যাত্মিক সাধক, আমরা সে মাপের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেনি। তবে আগামীতে আরো বড় মাপের অনুষ্ঠান আয়োজন করব তাঁকে নিয়ে। হাছন রাজার মরমী দর্শনকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব এজন্য যে তাঁর দর্শনে মানবের কল্যাণ নিহিত। জগতের শান্তি নিহিত মরমী দর্শনের মধ্যে আর এই মরমী দর্শনের রাজা হাছন রাজা।’
হাছন রাজার গানের মধ্যে বহু সিলেটি শব্দ রয়েছে যা আমাদের শেকড় উল্লেখ করে জহিরুল ইসলাম (অচিনপুরী) বলেন, শেকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচতে পারে না তেমনি কোন সংস্কৃতি যদি তার শেকড় ভুলে যায় সেই সংস্কৃতি টিকবে না৷
তিনি বলেন, ‘আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ভেতর যে সিলেটি সংস্কৃতি তার শেকড় অনেক বড়; অনেক গভীরে আমাদের শেকড়। সিলেটি সংস্কৃতির শব্দভাণ্ডারকে আঞ্চলিকতার দোহাইয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া যাবে না। সিলেটের শব্দভাণ্ডার দূর্বল নয়, সবল৷ এই শব্দ নিয়েই গান হবে, যেমন লিখেছিলেন আমাদের হাছন রাজা। প্রয়োজনে আমরা সাবটাইটেল দিয়ে সেই শব্দের অর্থ বুঝিয়ে দেব। কিন্তু সিলেটি শব্দ দিয়েই গান হবে।’
মরমী সাধক হাছন রাজার ১৭০ তম জন্মবার্ষিকী আগামীকাল। লোকে বলে বলে রে, ঘর বাড়ি ভালা না আমার; বাউলা কে বানাইলো রে এরকম আড়াই শতাধিক লোকগানের রচয়িতা ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জ শহরের তেঘরিয়া গ্রামে লক্ষণশ্রী পরগনার ধণাঢ্য জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী এবং মোসাম্মৎ হুরমত জান বিবির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন মরমী সাধক হাছন রাজা।
দেওয়ান অহিদুর রেজা চৌধুরী হাছন রাজা নামে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত। তাঁর কালজয়ী সব গান বাংলা সংস্কৃতির অনন্য নিদর্শন। প্রখ্যাত এ সাধক ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।