অলস দুপুরে অফিস ডেস্কে, হঠাৎ বিল্লাল ভাই ফোন দিলেন; বললেন ১৮তম প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামী ২৮-৩০ তারিখে আবারও কক্সবাজারের হোটেল সী ওয়ার্ল্ডে। আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে। তাহলে দেখা হচ্ছে কক্সবাজারে। যথা আজ্ঞা। তৎক্ষনাৎ ফোন দিলাম বিশ্বনাথ প্রতিনিধি কামাল মুন্না ভাইকে। উচ্ছ্বসিত কামাল মুন্না ভাই জানালেন, তিনিও প্রস্তুত, দেখা হবে, কথা হবে, আড্ডা হবে। আসলে কামাল মুন্না ভাইয়ের সাথে এর আগে আমার সামনা সামনি দেখা হয়নি। শুধু ফোনে ফোনেই কথা হয়। এদিক থেকে আমার আরেক সহকর্মী শান্তিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক হোসাইন আহমেদ ভাইও এক পায়ে খাড়া আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য।
২৭ সেপ্টেম্বর বুধবার সকাল ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে স্ত্রীকে বললাম আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিতে। স্ত্রী সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ‘আগে নাস্তা করে নাও, আমি সব কিছু আগে থেকেই গুছিয়ে রেখেছি।’ যাক বাঁচা গেল, এমন লক্ষ্মী বউ থাকতে গোছগাছ নিয়ে কি আর ভাবতে হয়! ঘড়ির কাটায় তখন ১০টা পনের মিনিট ফোনটা বেজে উঠলো। দেখি সহকর্মী হোসাইন আহমেদের ফোন। বললেন, ‘আপনার ভাবীকে ভর্তি করিয়েছি সিলেটের রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজে।’ জানলাম তিনি আবারও বাবা হতে যাচ্ছেন। তাই তিনি আর আমার সাথে যেতে পারছেন না। হোসাইন আহমেদ ভাই যেহেতু যাচ্ছেন না, একটু খবর নেই কামাল মুন্না ভাইয়ের। তিনি ফোন রিসিভ করেই জানালেন, উনার বোনের ছেলে আফ্রিকায় অসুস্থতায় মারা গেছেন। তাই কামাল মুন্না ভাইয়ের মনটা খারাপ, যাওয়ার সম্ভাবনাও কম। কি আর করা? তার পরও যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শান্তিগঞ্জে আমার অফিস লাইফ স্কিল কম্পিউটার একাডেমিতে চলে আসলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল কাজী ভাইয়ে কথা। যেই ভাবা সেই কাজ, চলে গেলাম কাজী ভাইয়ের অফিসে, কাজী জমিরুল ইমলাম মমতাজ, সভাপতি শান্তিগঞ্জ প্রেসক্লাব। চলার পথে আমার সুখ-দুঃখের সাথি। সাংবাদিকতায় সুদীর্ঘ ১৭-১৮ বছর যাবৎ একসঙ্গে পথ চলা। কাজী ভাইকে বললাম, বাড়ি থেকে তো বিদায় নিয়ে চলে এসেছি। এখন যাব কি না ভাবছি। আপনি যদি আমার সঙ্গে যান, তাহলে যাব, না হলে না। তিনি আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন! তিনি বললেন ‘আমার তো প্রস্তুতি নাই কেমনে যাই।’ বললাম প্রস্তুতি লাগবে না, গাড়িতে উঠব আর যাব। অবশেষে প্রস্তুতির জন্য উনাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে চলে আসলাম আমার অফিসে।
যাক, তাহলে আমরা দু’জন যাচ্ছি। বিকাল ৪টায় সিলেটগামী বাসে চেপে বসলাম আমরা দু’জন। গাড়ি যখন লামাকাজী চলে আসল কামাল মুন্না ভাই ফোন দিলেন। তিনি জানালেন, বাড়িতে মন ঠিকছে না। তাই তিনিও যাচ্ছেন। যথারীতি ৯টা ৩০ মিনিটের গাড়িতে আমরা চেপে বসলাম। রাত আনুমানিক ১০টা ৪০ মিনিটে হোসাইন ভাই জানালেন, তিনি ৩য় রাজকন্যার বাবা হয়েছেন। খুশির আমেজ নিয়ে তিনজন হেলেদোলে চলছি ৩৬০ আউলিয়ার দেশ হতে ১২ আউলিয়ার দেশে, জাতীয় দৈনিক যায়যায়দিনের ১৮তম জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৩।
২৮ তারিখ সকাল সাড়ে ৭টায় গিয়ে পৌঁছাই, চট্টগ্রাম শহরের ধামপাড়া বাসস্টপেজে। একটু খানাপিনা চা-নাস্তায় চাঙ্গা হয়ে নিলাম। যেখানে যেতে লাগে ১২ ঘণ্টা সেখানে ২১ ঘন্টায় গিয়ে নামলাম কক্সবাজার, যথারীতি তলপি-তলপাসহ হোটেল সী ওয়ার্ল্ডে। পথিমধ্যে দেখা হলো গাড়ির লম্বা সারি..(জ্যাম)! জশনে জুলুস ঈদে মিলাদুন্নবী (সাঃ) মোবারক র্যালি। উপভোগ করলাম কাজী ভাই, কামাল মুন্না ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা। নাট্যকার কামাল মুন্না কিভাবে সাংবাদিক হলেন। বলে রাখা ভাল হোটেল গেটেই আমাদের রিসিভ করলেন, যায়যায়দিন পত্রিকার সার্কুলেশন ম্যানেজার বিল্লাল হোসেন ভাই, সিনিয়র হিসাবরক্ষক মো. রইছ উদ্দিন ভাই। আমাদেরকে হোটেল রুমের চাবি বুঝিয়ে দিলেন। যথারীতি দুপুরে খাবার খেয়ে ২১ ঘন্টার জার্নিতে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই কাজী ভাই আর আমি চুপি চুপি কামল মুন্না ভাইকে রেখে লাবনী বিচে সূর্য্য অস্থাচলে। কক্সবাজারে এসে কি আর হোটেলে বসে থাকা যায়? কাজী ভাই আর মুন্না ভাইয়ের উৎপাতে রাতের খাবার শেষে আবারও তিনজন মিলে লাবনী ও সুগন্ধা বিচে, সমুদ্র দর্শনে।
২৯ সেপ্টেম্বর সকালে টি-শার্ট আর আইডি কার্ড পড়ে এসে দেখি সাদায় সাদায় লোকারণ্য, সারা দেশ থেকে যায়যায়দিন পত্রিকার প্রতিনিধিরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রতিনিধি সম্মেলনের র্যালির জন্য। সাদায় সাদায় আর কমলা রঙের এক অন্যরকম আবহ! আবারও ধন্যবাদ জানাই পত্রিকার আরিফুল ইসলাম ভাইকে আমাদের সাজিয়ে দেওয়ার জন্য সঙ্গে আমার জন্য একটু মিষ্টি বকুনী, বউকে কেন নিয়ে আসিনি!
সাড়ে ১০টায় শুরু হওয়া র্যালি হোটেল সী ওয়ার্ল্ডে হতে একেবারে লাবনী বীচ, নিচে তপ্ত বালুরাশি, উপরে নীল আকাশ, সাগরের গর্জন, মানুষের হৈ-হুল্লোড়, ষোল কোটি মানুষের জন্য প্রতিদিন-যায়যায়দিন। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, সৈকতেই চলছে আমাদের যায়যায়দিন প্রত্রিকার প্রতিনিধি সম্মেলনের র্যালি পরবর্তী খেলাধুলার আয়োজন। কেউ বা ফুটবল, কেউ আবার হা-ডু-ডু কেউ বা আবার সেলফি তোলায় মত্ত। অন্যদিকে পত্রিকার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার মো. নুরুল হক ভাইকে নিয়ে টানা-টানী, কে কার আগে তাঁর সঙ্গে ক্যামেরা বন্দি হবেন। ক্যামেরার ক্লিক আর ফ্লাশ লাইটের আলোতে সাদায় আর বালুরাশির ঝলকানি। চারিদিকে শুধু ধ্বনিত যায়যায়দিন-যায়যায়দিন।
এদিকে কক্সবাজারে এসেছি আর সমুদ্রে ঝাঁপ দিব না তা কি হয়? বিশেষ করে কাজী ভাই আর মুন্না ভাই সেই কখন থেকেই প্রস্তুত! শুধু সময় ও সুযোগ হচ্ছিল না, তাই আমরাও নামলাম সাগর জলে। সাগরের পানিতে লাফা-লাফি-ঝাপা-ঝাপি, কাজী ভাইয়ের আরেকটি এক্সপেরিমেন্ট ‘সাগরের পানি কেন নুনা হয়!’ সাগরের নীল জল মেখে আর সাদা ফেনা রাশিতে সমস্ত ক্লান্তি রেখে চলে আসলাম লাবনী পয়েন্ট মসজিদে। স্রষ্টার উদ্দেশ্যে নতজানু হই। হে খোঁদা তোমার সৃষ্টি এতো সুন্দর, বৈচিত্রময়, না জানি তুমি কত সুন্দর!
সন্ধ্যায় হোটেলের হলরুমে প্রতিনিধি সম্মেলনের মূল আয়োজন, আলোচলা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও পুরস্কার বিতরণ। গান বাজনা আর যন্ত্র সংগীতের তালে তালে প্রকম্পিত হচ্ছিল হোটেল সী ওয়ার্ল্ড। হঠাৎ সবকিছু থেমে যায়… কি ব্যাপার? সুনশান নীরবতা! রইছ উদ্দিন ভাই মাইক হাতে কাঁদোকাঁদো স্বরে জানালেন চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বর্ষীয়ান সাংবাদিক, হেলাল উদ্দিন চৌধুরী আর নেই। ইন্নালিল্লাহি….রাজিউন। স্তব্ধ হয়ে যায় সব কোলাহল। হায় মানুষের জীবন! যে মানুষটা আজ সকালে ১৮তম প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগ দিতে ছুটে এসেছিলেন, কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে ছিলেন, সেই মানুষটাই এখন আর নেই। গোটা যায়যায়দিন পরিবার শোকে স্তব্ধ। তাই পরবর্তী আলোচনাসভা সংক্ষিপ্ত করে সারা দেশের প্রতিনিধিধের হাতে পুরস্কার তোলে দিয়ে ১৮ তম জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলনের মিলনমেলা সমাপ্ত হয়।
একে একে বিদায় নিলেন পরিচিত জন, আমরা তখন কপির আড্ডায় সুগন্ধা বিচে। কফি হাতে নিয়ে প্রেম পিপাসায় কাতরতা, প্রিয়তমা সাগরের চেয়ে বিশাল আমার এই ভালোবাসা। প্রেমে মত্ত প্রেমিক যুগল। ‘মানুষ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা পাঠে আর কামাল মুন্নার নাটকের ডায়লগে প্রেমে আর সাগরের জলে একাকার।
৩০ সেপ্টেম্বর, কি অপরূপ সৃষ্টি! একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, সারি সারি ঝাউবন। মাঝখানে মেরিন ড্রাইভ রোড। আপনারা নিশ্চই আন্দাজ করতে পারছেন কোথায় চলে এসেছি, ইনানী বিচ, অসাধারণ! চলার পথে চোখে পড়ছিলো ছোট-ছোট মাছ ধরার ট্রলার। কখন যে ২৭ কিলোমিটার পথ শেষ হয়ে গিয়ে ইনানী বিচে পৌঁছেছি বুঝতেই পারিনি।
ইনানী বিচ ঘুরে ফেরার পথে হিমছড়ি ঝর্ণা, ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র এবং অবশেষে আমাদের ‘এভারেস্ট’ জয়! হিমছড়ি পাহাড়ের চূড়ায় যখন উঠছিলাম তখন অর্ধেক পথেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। পা আর চলছিল না। তারপর সিঁড়িতে রেস্ট নিয়ে আবারও পথচলা। এক পর্যায়ে পাহারের চূড়ায় উঠে মনে হলো আমরা যেন এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। আহা কি অসাধারণ! এক পেয়ালা চায়ে সমুদ্র দর্শন! অসাধারণ মেরিন ড্রাইভ, ঝাউ বন, সাগরের সাদা-সাদা ফেনা রাশি।
টকমিষ্টি ঝাল আনারকলি! আর স্যালমন ফিস! জিব্বায় যেন এখনো স্বাদ পাচ্ছি। আহা আফসোস! ইচ্ছে থাকার পরও কামাল মুন্না ভাইয়ের খাওয়া হল না স্যালমন ফিস, আর আফসোস আমাদের আরেক বন্ধু জেমস্ ভাইয়ের জন্য! এক সঙ্গে সমুদ্রে ঝাঁপ দেয়া হল না। তাই দিন শেষে নেটিং-চ্যাটিং, ফটো শেয়ারিং।
অপরূপ রাজ্য আর রাজকন্যাকে ফেলে আবারও ঝাঁপ দিতে হবে কর্ম ব্যাস্ততায় যথারীতি হোটেলে ফেরা। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়া এবং বিদায় নিলাম যায়যায়দিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হালিফ রাঈস চৌধুরীর কাছ থেকে। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলির সভাপতি ও প্রকাশক সাঈদ হোসেন চৌধুরী, ভারপ্রাপ্ত সম্পদক কাজী রুকুনউদ্দীন আহমদসহ পত্রিকা পরিবারকে। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফসল ছিলো ১৮-তম জাতীয় প্রতিনিধি সম্মেলন-২০২৩। প্রত্যন্ত উপজেলাসহ সারা দেশের কমলসৈনিকেরা এসেছিলেন আবেগ আর উচ্ছ্বাসে। যায়যায়দিন পত্রিকার কাছে তুলে ধরেছেন তাঁদের সমস্যা ও প্রত্যাশা। সব বাঁধা কাটিয়ে কিভাবে এগিয়ে যাবে সময়ের এই সাহসী কণ্ঠস্বর? যায়যায়দিন পত্রিকা হবে দেশের নির্ভরযোগ্য আস্থাশীল। খবরের অন্তরালের খবর পৌঁছে দিয়ে ১৮ কোটি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ঠাঁই করে নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। দুঃসাহসিক পদযাত্রায় সঙ্গী হবে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত প্রতিটি শহর-বন্দর-গ্রামে কর্মরত যায়যায়দিন প্রতিনিধিরা।
“ষোলকোটি মানুষের জন্য প্রতিদিন” এই স্লোগানকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাক যায়যায়দিন। আগামীতে আবারও দেখা হবে হয়তো সাজেক বেলী, না হয় চায়ের দেশ সিলেটে না হয় মৎস্য পাথর ধান খ্যাত সুনামগঞ্জে। পত্রিকা পরিবারের কাছে এই প্রত্যাশায়…
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী (শান্তিগঞ্জ প্রতিনিধি, দৈনিক যায়যায়দিন)