ভাষা আন্দোলন আমার গৌরব আমার ইতিহাস

একটা গোটা জাতির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে,মায়ের ভাষাকে মুছে দিয়ে উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়ার সেই প্রস্তাবক আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমদ আজ নেই। কে কখন, কিভাবে তাকে স্মরণ করে তাও জানি না। কিন্তু আমার শহিদমিনার এখনো আছে। আর কিছু নাই হোক ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় তার পাদদেশ। সগৌরবে মাথা উঁচু করে বয়ে নিয়ে যায় আমাদের দেশপ্রেম। কোটি কোটি বাঙালি প্রভাতফেরীতে গেয়ে ফেরে ভাই হারানোর গান।

সেই রেসকোর্স আজও আছে। নাম বদলেছে। যেই রেসকোর্সে দাড়িয়ে জিন্নাহ বলেছিলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু”। সেই রেসকোর্সে, জ্বি আপনি ঠিকই দেখছেন- সেই রেসকোর্সের ময়দানে দাঁড়িয়েই ঠিক ২২ বছর পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” কেউ দাবায় রাখতে পারবা না…।


সেই লিয়াকত আলী খান নাই। স্মৃতিতে শ্রদ্ধায় কিন্তু বরকত, সালাম, জব্বাররা আছে ভালবাসায় কবিতায়। সেই কার্জন হলে আজও বাংলায় চলে আড্ডা কবিতা গান। নেই শুধু জিন্নাহ নাজিমুদ্দিনের দম্ভোক্তির ছিটে ফোঁটাও।


সত্যিই সপ্তম নৌবহর, বিদেশি ষড়যন্ত্র, দেশী দালালদের বেইমানী, ভারী অস্ত্র, গ্রেনেড, বুলেট, ট্যাংক, গণহত্যা, নির্যাতন কিছুই আর বাঙালিকে দাবাতে পারে নাই।

সেই লিয়াকত আলী খান নাই। স্মৃতিতে শ্রদ্ধায় কিন্তু বরকত, সালাম, জব্বাররা আছে ভালবাসায় কবিতায়। সেই কার্জন হলে আজও বাংলায় চলে আড্ডা কবিতা গান। নেই শুধু জিন্নাহ নাজিমুদ্দিনের দম্ভোক্তির ছিটে ফোঁটাও।

১৯৫২ সালের ২৭ শে জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে আবারও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলো। মাঝপথে অনেক রক্ত ক্ষয় আর সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের সেই ২৭শে জানুয়ারি জুলফিকার আলী ভুট্টো, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠক করছেন অবনত মস্তকে। দেনদরবার চলেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর একটাই কথা ছয় দফা মেনে নেও, নির্বাচিত বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো, আর্মি ব্যারাকে ফেরাও, সব হত্যার বিচার করো এবং সব রাজনৈতিক বন্দীর মুক্তি দাও।

মায়ের ভাষাকে মুক্ত করতে যেয়ে ২৩ বছরের সংগ্রামে পেয়ে গেলাম এক মুক্ত স্বাধীন নিজের দেশ। পেয়ে গেলাম এক বাঙালি জাতীয়তাবাদ এর বাংলাদেশ। অশ্রু মুছে মুনীর চৌধুরী লিখে ফেললেন “কবর” নাটক। আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন গান “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। ভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম কবিতা রচনা করেন মাহবুবুল আলম চৌধুরী। তিনি লিখলেন ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। কতো গল্প, কতো কবিতা এবং কতো শত প্রবন্ধে আমার অমর একুশে ছুয়ে গেলো আমাদের।

২৩ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের এবং অন্যান্যদের সহযোগিতায় বানানো প্রথম শহিদমিনার গুড়িয়ে দিয়ে এ চেতনা হয়েছিল আরও পোক্ত, আরও শক্তিশালী।

আমাদের গৌরব আমাদের অহংকার আমাদের একুশ। আমাদের শোকের দিন, কান্নার দিন, আবেগের দিন এবং অবশ্যই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম ধাপ আমাদের ২১শে ফেব্রুয়ারি, ৮ই ফাল্গুন, আমাদের ভাষা আন্দোলন।

  • ডা. মোহাম্মদ হাসান। চিকিৎসক ও পেশাজীবী সংগঠক।