আমার সুফি চাচা

হাতালি মাঠে ফুটবল খেলা শুরু হয়েছে। গ্রামের ফুটবল মাঠ। পাকিস্তান জিন্দাবাদের সময় তখন। জীবনে প্রথম বাড়ির পাশের এ মাঠে গিয়েছি। কারণ আমার সুফি চাচা খেলবেন। সাথে দুইজনের পাহারাদার দেয়া হয়েছে। যেন আমি নিজেই খেলায় নেমে না পড়ি। খেলা দেখা আর খেলায় নেমে পড়ার বিভ্রান্তি আমার সেই বাল্য শৈশব থেকেই।

খেলা শুরু হয়ে গেছে। শফিক মাস্টার খেলছেন একদিকে। অন্যদিকে আমার সুফি চাচা। গ্রামের ফুটবলপ্রাণ যুবক ভেলাই, রিয়াজ। শফিক মাস্টার একদিকের গোলের সীমানা থেকে বলে কিক মারছেন, বল পড়ছে গিয়ে অন্যদিকের গোল কিপারের হাতে। তাঁর মতো বলে কিক দেয়ার লোক তখন এ তল্লাটে ছিলেন না।

আমাদের অঞ্চলে ফুটবলের প্রবাদ পুরুষ ছিলেন শফিক মাস্টার। আমার বাবার ছাত্র ছিলেন। একসময় নিজেও আমাদের প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতে আসতেন পাশের গ্রাম থেকে। আমাদের গ্রামের স্কুলগুলো তখনও গুরুমশাইয়ের পাঠশালাই ছিল। শফিক মাস্টারকে স্যারই ডাকতাম। শফিক স্যার বলেছিলেন, বড় হলে ফুটবল খেলা শিখাবেন। তাঁর কাছে আমি কোনদিন বড়ও হতে পারিনি। ফুটবলেও লাথি মারা শেখা হয়নি আমার।


এক মায়ের উতলা মনের খবর সেদিন ধাতস্থ করতে পারিনি। সুফি চাচা ফিরে আসেননি। যুদ্ধ শেষ হলে সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকার বধ্যভূমিতে খোঁজা হয়েছে তাঁর লাশ। বধ্যভূমিতে হাড়ের স্তূপ! দেশের জন্য আত্মহুতি দেয়া জানা অজানা বীরদের সাথে মিশে গেছে শহীদ সুফির মরদেহ!


তখনও গ্রামের এসব ফুটবলে কারও পায়ে বুট দেখিনি। খালি পায়ে লুঙ্গি কায়দা করে গিট দিয়ে খেলা চলছে। সুফি চাচা এবং আর দুই একজন হাফপ্যান্ট পরেছেন। কিছুক্ষণ পর পর ‘গোল! গোল!’ চিৎকার হচ্ছে। মাঠের পাশে বসে এলাকার সম্পন্ন জমিদার চেরাগ মিয়া মাঝেমধ্যে হুংকার দিচ্ছেন। খেলার রেফারি মিন্টু ডাক্তার। গ্রামীণ ডাক্তার মিন্টু বিশ্বাস খেলা শেষ হওয়ার বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন। চেরাগ মিয়ার পাশে বসা গ্রামের মাতবর তৈয়ব আলী- জয় বাংলা স্লোগান ধরেছেন।

সত্তরের নির্বাচনের কিছু আগের ঘটনা। বাংলার জনপদে তখন জয় বাংলা স্লোগান উচ্চারিত হতে শুরু করেছে। পশ্চিম গ্রামের খেলোয়াড়দের পাকিস্তান জিন্দাবাদ দিতে দিতে সেই গ্রামের মাতবর বাছা মিয়ার পেছনে পেছনে যেতে দেখি।বাছা মিয়া পরে রাজাকার কমান্ডার হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাছা মিয়াকে আর পাওয়া যায়নি। এখনো রাজাকার নাম উচ্চারিত হলে বাছা মিয়ার কথা মনে পড়ে!

খেলায় আমাদের গ্রামর দল পাঁচটি গোল করেছে। সুফি চাচা একাই গোল করেছেন তিনটা। তখন জেলা দলে খেলতেন শফিক মাস্টার। সুফি চাচার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, আমাদের সুফি একদিন জাতীয় দলে খেলবে!
জমিদার চেরাগ মিয়া সুফি চাচার গলায় কাগজের মালা পরিয়ে দিলেন।

হাতালি মাঠের পশ্চিম দিগন্তে অস্তগামী সূর্যকে পিছনে রেখে হাঁটছিলেন সুফি চাচা। পেছনে পেছনে লোকজন স্লোগান দিচ্ছিল- জয় বাংলা! দীর্ঘদেহী সুফি চাচা। নায়কের মতো হাঁটছেন! জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত গ্রাম!

সত্তরের নির্বাচনের কিছু আগের সময়টা। জয় বাংলা স্লোগান তখন নতুন স্লোগান। আলাদা উদ্দীপনার। আলদা শিহরণের। নির্বাচনের ডামাঢোল চারদিকে। পাকিস্তান ফেরত কর্নেল ওসমানী আমাদের এলাকা প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। মুখে মুখে তখন বঙ্গবন্ধু আর শেখ মুজিবের নাম। এরমধ্যেই জানা গেলো, গ্রামের মাঠ ছেড়ে সুফি চাচা পুলিশের চাকুরীতে যোগ দিয়েছেন। গ্রামের সবাই বলাবলি করতে থাকলো, পুলিশের হয়ে জাতীয় লীগে একদিন খেলবেন বাঘা গ্রামের সুফি।

মায়ের একমাত্র ছেলে সন্তান সুফি পুলিশের প্রশিক্ষণ শেষ করতে পারেননি। জাতীয় দলে তাঁর ফুটবলও খেলা হয়নি। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ সুফি চাচা সারদা ট্রেনিং একাডেমীতে ছিলেন। রাজশাহী থেকে পায়ে হেঁটে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে নিজের গ্রামে ফিরেছিলেন। মধ্যরাতে দরজায় টোকা দিয়ে মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সুফি। মায়ের বুকে মাথা লাগিয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েও নিয়েছিলেন। শান্তির ঘুম। চাচাতো ভাই মঈন উদ্দিন চৌধুরীর পরামর্শে আবার বাড়ি ত্যাগ করতে হয়েছিল।

শহর থেকে পালিয়ে আসা লোকজনের ভীড়ে তখন আমাদের বাড়ি শরনার্থী শিবির। ঘুম থেকে উঠেই সুফি চাচার সংবাদ জানতে পারি। আমার বাবার চাচী, সুফি চাচার মা। রাতে তাঁর ছেলের ঘরে ফেরা আর চলে যাওয়ার গল্প করছিলেন। বলছিলেন, মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটায় ফুলে উঠা পা নিয়ে ছেলেটি চলে গেছে। গেছে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে!

যাওয়ার আগে গুড়ের সন্দেশ খাইয়ে দিয়েছেন ছেলেকে! মায়ের হাতে এ সন্দেশটা সুফি চাচার প্রিয় ছিল।

আগস্ট মাসের এক রাতে সুফি চাচা ভারত থেকে গ্রামে এসেছিলেন। পকেটে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক দেওয়ান ফরিদ গাজীর চিঠি। গ্রাম থেকে যুবকদের নিয়ে রাতেই সুফি চাচা ভারতের পথে হাঁটতে শুরু করলেন। কয়েক গ্রাম হাঁটার পর সূর্য উঠছে। সঙ্গী জলিল, ফারুকসহ এক বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। সূর্য ডুবলে আবার যাত্রা শুরু করবেন বলে। সে যাত্রা আর শুরু হয়নি। ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় রাজাকারের দল। তুলে দেয় পাক হানাদার বাহিনীর কাছে।

সিলেট ক্যাডেট কলেজে তাদের বন্দি করে রাখা হয়। পাক সেনারা নির্যাতন শুরু করে। পকেটে পাওয়া চিঠির জের ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ঠিকানা চায় সুফি চাচার কাছে। নির্যাতনের পর ফারুক ও জলিলকে সিলেট কারাগারে পাঠিয়ে দেয় পাক সেনাবাহিনী। জান্তা সরকার তখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল। কিছু কারাবন্দিকে মুক্তি প্রদান করলে সুফি চাচার সঙ্গী, আমাদের গ্রামের ফারুক ও জলিল ছাড়া পেয়েছিলেন। দেশের জন্য লড়তে যাওয়া গ্রামের সাধারণ এ যুবকরা প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছিলেন। ফিরতে পারেননি সায়েফ উদ্দিন চৌধুরী। আমার সুফি চাচা। ফারুক, জলিলের সাথে ফিরেছিল কিছু লোমহর্ষক গল্প। এ গল্প আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি।

মুক্তি পাওয়া যুবকদের কাছ থেকে সুফি চাচার গল্প শুনেছি। সুফি চাচার উপর নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁরা কেঁদেছেন। অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করেও সুফি চাচা তাঁর জ্ঞাতি ভাইদের নাম বলেননি। প্রকাশ করেননি কোন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়। এ পরিচয় জানতে পারলে পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো পাক হানাদাররা। এমন ভয়ে তটস্থ ছিল পুরো গ্রাম।

দেশ স্বাধীন হলে মঈন উদ্দিন চৌধুরীরা বীরের বেশে দেশে ফিরে আসেন। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সেদিন বীরদের আগমনে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাঘা গ্রাম। মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পাওয়া বীরদের দর্পিত আগমনে একাত্তরের সোনালী ডিসেম্বরে স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন হয়েছিল। বাড়ির সামনের মাঠে লাল সবুজের পতাকা উড়ছে। তাকিয়ে আছেন সুফি চাচার মা, আমার দাদী।

এক মায়ের উতলা মনের খবর সেদিন ধাতস্থ করতে পারিনি। সুফি চাচা ফিরে আসেননি। যুদ্ধ শেষ হলে সিলেট ক্যাডেট কলেজ এলাকার বধ্যভূমিতে খোঁজা হয়েছে তাঁর লাশ। বধ্যভূমিতে হাড়ের স্তূপ! দেশের জন্য আত্মহুতি দেয়া জানা অজানা বীরদের সাথে মিশে গেছে শহীদ সুফির মরদেহ!

শহীদ সুফির মা, চেয়ে থাকতেন দরজা খোলা রেখে। বছরের পর বছর গেছে। মা পথ চেয়ে বসে থাকতেন, ছেলে ফিরবে বলে!

একমাত্র ছেলে সন্তান হারিয়ে শহীদ সুফির মা বেঁচে ছিলেন আরও চার দশক। অশ্রুর স্রোতধারায় তাঁর গালে স্থায়ী ক্ষত দেখেছি। এ ক্ষতচিহ্ন বয়ে গেছেন চারটি দশক। তাঁর হৃদয়ের ক্ষত দেখিনি। দেখার কোন ক্ষমতা নেই বলে চেষ্টাও করিনি। সন্তানহারা মায়ের বেদনা পরখ করে দেখার নয়, পরিমাপ করারও নয়!

গুড়ের সন্দেশ বানাতেন আমাদের এ দাদী। প্রতি ঈদে এ সন্দেশ খাওয়ার জন্য আমার অবধারিত গন্তব্য ছিল সুফি চাচার ঘরে। যুদ্ধের আগে সুফি চাচার সাথে বসে সন্দেশ খেতাম। যুদ্ধের পর সন্দেশ খেতে খেতে বলতাম, দাদি আপনি খাবেন না?
: না ! আমার সুফি বড় শখ ছিলো এ সন্দেশ খাওয়ার!
শেষবারের মতো এ সন্দেশ খাইয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে বিদায় দিয়েছিলেন ছেলেকে। ছেলে আর ফিরেনি। প্রতি ঈদে আমার দাদী সন্দেশ হাতে নিয়ে বলতেন, একদিন ঠিকই ছেলে ফিরে আসবে! সুফি চাচা ফিরে আসেননি।

দেশের জন্য যুদ্ধ করা আমাদের গ্রামের বাড়িতে এখন আর কোন মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে নেই। দেশ স্বাধীন করে দেশের কাছে তাদের কারও কাছে কোন কিছু চাওয়া পাওয়ার ছিল না। খেতাব, পদকের জন্য দৌড়ঝাঁপ দিতে দেখিনি কোনদিন। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন, এ দাবী নিয়ে কারও কাছে যাওয়ার বিকার দেখিনি কোনদিন! সুফির মা ছেলের অপেক্ষা করতে করতে বিরান ভিটে রেখে নিজেও চলে গেছেন। সে ভিটেতে এখন ঘুঘু উড়াল দেয়। জানান দেয়, উড়াল দেয়ার স্বাধীনতা!

বাড়ির পাশ দিয়ে গেলে কেউ কি থমকে দাঁড়ায়? দেশ কিছু করেন শহীদ সুফির জন্য। স্বজনদের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে বাঘা গ্রামে শহীদ সাইফ উদ্দিন চৌধুরী সুফি তোরণ!

নাগরিক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আমরা জানি। তাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস হয়। কৃতিত্ব আর গৌরব গাঁথার নাগরিক বাণিজ্য হয়। অজো পাড়া গাঁয়ের পথটি অতিক্রম করতে গিয়ে কারও কি একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে? সম্ভাবনাময় এক সাহসী বীরের আত্মাহুতিতে স্বাধীন স্বদেশে কারও কি মাথা নুইয়ে আসে বিনম্র কৃতজ্ঞতায়?

  • ইব্রাহিম চৌধুরী। সম্পাদক, প্রথম আলো, উত্তর আমেরিকা।