রাত পোহালেই বুধবার (১৫ জুন) সকাল থেকে এই প্রথম ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) শুরু হবে বিয়ানীবাজার পৌরসভার দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ।
নির্বাচনে ২৭ হাজার ৭শত ৯৩জন ভোটার তাদের নগরপিতা নির্বাচন করবেন। শেষ সময়ে এসে পৌরবাসীর দৃষ্টি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী সদ্য সাবেক মেয়র মো. আব্দুস শুকুর এবং আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত বিদ্রোহী প্রার্থী ফারুকুল হক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুস সবুরের দিকে। শেষ হাসি কার? পরিবর্তন নাকি প্রত্যাবর্তন- এ নিয়েই সর্বত্র চলছে আলোচনা।
বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনে অতীতের মতো এবারও রাজনৈতিক দলের চেয়ে অনেক অঞ্চল বা এলাকার প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন পৌরবাসী। সে সম্ভাবনা নির্বাচনী প্রচারণা শেষ দিনেও পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রচারণা ও শেষ নির্বাচনী সভায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষে নিজ নিজ এলাকার দলমত নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ অংশ নিয়েছেন। এতে কিছুটা হলেও বেকায়দায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. আব্দুস শুকুর। নিজ এলাকার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) প্রার্থী জিএস ফারুকুল হক (চামচ) তাকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছেন।
আরও পড়ুন : বিয়ানীবাজার পৌর নির্বাচন : কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা
কসবা-খাসা এলাকার ২, ৩ ও ৪নং ওয়ার্ডের মধ্যে ৩ ও ৪নং ওয়ার্ড কেন্দ্রে নৌকার সাথে হাড্ডাহাড্ডি অবস্থানে রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী জিএস ফারুকুল হক। একইসাথে ১৯৯৫ সালে বিয়ানীবাজার সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে তাঁর উপর জামায়াত-শিবিরের নির্যাতনের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করেছেন জিএস ফারুকুল হক। নৌকার পাশাপাশি পৌর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার লড়াইয়ে তাঁর যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
এ দুই মেয়র প্রার্থীর সাথে সাবেক পৌর প্রশাসক তফজ্জুল হোসেন (জগ), আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী (স্বতন্ত্র) আব্দুল কুদ্দুছ টিটু (হেলমেট) এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আব্দুস সবুর (মোবাইল) এর বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে তাদেরকে নিজ নিজ এলাকার শতভাগ সমর্থন আদায় করতে হবে। সাবেক পৌর প্রশাসক তফজ্জুল হোসেনের গলা কাঁটা তার আপন মামাতো ভাই যুক্তরাজ্য প্রবাসী অজি উদ্দিন। ফতেহপুর গ্রাম থেকে একক প্রার্থী থাকলে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। এ দুই প্রার্থী বাড়ি ফতেহপুর এলাকায় (৬নং ওয়ার্ড) হওয়ায় ভোটাররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
১ ও ২নং ওয়ার্ড নবাং ও শ্রীধরা এলাকার প্রার্থী আব্দুস সবুর ও আব্দুল কুদ্দুছ টিটু। নবাং শ্রীধরা অতীতের সকল নির্বাচনে (ইউনিয়ন থেকে পৌরসভা) একক প্রার্থী দিলেও এবার আব্দুস সবুর ও আব্দুল কুদ্দুছ টিটুকে নিয়ে বিভক্ত নবাং ও শ্রীধরা এলাকাবাসী। এলাকার একক প্রার্থী হলে আব্দুল কুদ্দুছ টিটু কিংবা আব্দুস সবুর দুইজনেরই বিজয়ের সম্ভাবনা ছিল নির্বাচনে।
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী জিএস ফারুকুল হক বলেন, ‘পৌরবাসী পরিবর্তন চায় এবং দূর্নীতিমুক্ত পৌরসভা চায়। আমি তাদের আশ্বস্থ করেছি নির্বাচিত হলে দুর্নীতিমুক্ত কাঙ্খিত উন্নয়ন করবো।’
সদ্য সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আব্দুস শুকুর বলেন, নৌকার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিগত নির্বাচনে নৌকার বিজয়ের সুফল মানুষ ধরে রাখতে চায়। পৌরবাসীর সেই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে এবারের নির্বাচনেও।
স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুস সবুরও নিজের বিজয় নিয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমার নির্বাচনি প্রচারণা ও সভায় ভোটারদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ আমাকে আশ্বস্ত করেছে। বিজয় নিশ্চিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এবারের পৌর নির্বাচনে ১০জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে অপর চারজন হচ্ছেন- জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী সুনাম উদ্দিন (লাঙ্গল), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির মেয়র প্রার্থী এড. আবুল কাশেম (কাস্তে), স্বতন্ত্র মেয়র প্রভাষক আব্দুর সামাদ আজাদ (হ্যাঙ্গার) ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আহবাব হোসেন সাজু (কম্পিউটার)। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী আহবাব হোসেন সাজু ও প্রভাষক আব্দুস সামাদ পৌরসভার দক্ষিণ পার্শ্বের প্রার্থী হওয়ায় এবং নিজেদের ব্যক্তি ইমেজের কারণেও ভোটযুদ্ধের বিজয়ে অনেকটা উপরের দিকে রয়েছেন।
জানা গেছে, এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত কোন প্রার্থী। পৌর এলাকায় রাজনৈতিক এই দল দুটোর নির্দিষ্ট একটি ভোটব্যাংক রয়েছে। একক কোন প্রার্থী কি পাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের সমর্থন, নাকি এলাকাভিত্তিক প্রার্থীরা এসব ভোটে ভাগ বসাবেন তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা। তবে দলীয়ভাবে প্রকাশ্যে কোন প্রার্থীকে সমর্থন না আসলেও শেষ মুহূর্তে কোন না কোন প্রার্থীকে সমর্থন জানাতে পারেন দল দুইটির স্থানীয় নেতারা। তাদের সে সমর্থনে কতটুকু এগিয়ে আসবেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা তারপর উপর নির্ভর করছে নির্বাচনের ফলাফলের সম্ভাবনা। কিন্তু এলাকাভিত্তিক প্রার্থীদের পক্ষে দল দুইটির অধিকাংশ নেতাকর্মী মাঠ পর্যায়ে প্রচারণায় যুক্ত থাকায় দলীয় কোন সিদ্ধান্ত কিংবা নির্দেশনা বুমেরাং হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
সরকার দলের বিরোধী বলয়ের এই দল দুটির স্থানীয় সূত্র জানায়, এবারের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের কোন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে দল দুটোর স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ফলে ১৫ জুনের ভোটে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত ভোট যেকোন প্রার্থী পক্ষে যেতে পারে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টদের অভিমত, এবারের নির্বাচনে নারী ভোটারদের হাতেই জয়-পরাজয়ের সমীকরণ নির্ভর করবে। নারী ভোটারদের উপস্থিতি এবং তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার উপর নির্ভর করছে মেয়রের ভাগ্য। তারা বলছেন, নারী ভোটাররা পাল্টে দিতে পারেন এবারের জয়-পরাজয়ের হিসাব।
বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনে ৯ ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৪৮ এবং ৩টি সংরক্ষিত মহিলা আসনে ১০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। নির্বাচনকে ঘিরে আলোচনায় ভোটাররা। প্রথমবারের মতো ইভিএমে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট প্রদান নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন তারা।
এদিকে, সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করতে যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করেছে বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা কার্যালয় ও উপজেলা নির্বাচন অফিস। মঙ্গলবার পৌর নির্বাচনের ১০টি কেন্দ্রের সবগুলোতেই সিটিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। এর আগে সোমবার মধ্যরাত থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল নির্বাচনি এলাকায় টহল জোরদার করেছেন। নির্বাচনের দিন ১০টি কেন্দ্রে ৯জন ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে একাধিক স্টাইকিং ফোর্সসহ চারস্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বুধবার মধ্যরাত পর্যন্ত যান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হিল্লোল রায় জানান, ভোটের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে নিরাপত্তার জন্য বিপুল পরিমাণে পুলিশ মোতায়েন থাকবে। একইসাথে পৌরসভার সকল প্রবেশপথে মঙ্গলবার বিকাল থেকে তল্লাসি চৌকি বসানো হয়েছে।
বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারি রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আশিক নূর জানান, ভোটগ্রহণের দিন প্রতিটি কেন্দ্রে বিপুল সংখ্যক আনসার, পুলিশ ও আমর্ড পুলিশ মোতায়েন থাকবে। হামলাসহ যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবেলায় একাধিক স্ট্রাইকিং ফোর্স দায়িত্ব পালন করবে। এ লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।
বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত রিটার্নিং কর্মকর্তা ও মৌলভীবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে করণীয় সবকিছু এরই মধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। সব প্রার্থীকে নির্বাচনের প্রচার প্রচারণা যেভাবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দেয়া হয়েছিল। তেমনি ভোটের দিন এবং ফলাফলের আগ পর্যন্ত সব একইভাবে থাকবে। তিনি নির্বাচনকে উৎসবে পরিণত করতে সকল প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর প্রতি আহবান জানান।
এর আগে ২০০১ সালে পৌরসভা গঠন পর সীমানা নির্ধারণসহ নানা আইনী প্রতিবন্ধকতা সমাধান শেষে ২০১৭ সালে প্রথম বিয়ানীবাজার পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।