শিক্ষিত মানুষদের মধ্যেও বিবর্তনবাদ নিয়ে ভুল ধারণা আছে। বিবর্তনবাদ নিয়ে যে কোন আর্টিকেলে মানুষের বিবর্তনের যে চিত্রটি দেয়া হয় সেটাও কিন্তু ভুল। সেখানে দেখানো হয় মানুষ বানর থেকে বিবর্তিত রূপ নিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসেছে। এই ধারনা সম্পূর্ণ ভুল। স্বয়ং ডারউইন চার্লস রবার্ট ডারউইনও এমন কোন কথা বলে যাননি। বরং তিনি বলেছিলেন বানর, শিম্পাঞ্জি, ওরাংগুটাং, গরিলা, মানুষ সবাই একই পূর্বপুরুষের বংশধর যারা পৃথিবীতে দু-পায়ে হাঁটা শুরু করেছিলো। একই ধারায় অনেক প্রজাতি আছে। বানর তাদের মধ্যে একটা, মানুষও সেই ধারায় একটা প্রজাতি।
তৎকালে এই তথ্য প্রমাণের জন্য ডারউইনের কাছে সংগ্রহ করা নমুনা এবং ফসিল ছাড়া শক্ত কোন প্রমাণ ছিলো না। তিনি নিজেও জানতেন তার বিবর্তনবাদের থিউরি অনেক সমস্যা হবে। কারণ মানুষ উল্লুক প্রজাতির (এইপ লাইক ক্রিয়েচার) বংশধর তা মেনে নেয়ার মত মন-মানসিকতা তখনো কারও ছিলো না। তাছাড়া ঐ সময়কার চার্চগুলো ছিলো প্রচণ্ড প্রতাপশালী, ব্রুনো, কোপার্নিকাস কিংবা গালিলির জীবনী থেকে তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।
প্রশ্ন হতে পারে, মানুষ বা বানরের পরিবর্তিত রূপ আমরা কেন দেখছি না? এই প্রশ্নের সাথে আরেকটি প্রশ্ন আপনি মিলাতে পারেন, আপনার শহরে একটি পিঁপড়া ছেড়ে দিয়ে আপনি অপেক্ষা করছেন এটি কোনদিন হেঁটে হেঁটে সাহারা মরুভূমিতে যাবে!!! ব্যাপারটা থিউরিটিক্যালি সম্ভব কিন্তু প্রাকটিক্যালি অসম্ভব। পিঁপড়া রওনা দিলে তার জীবদ্দশায় তার বংশবৃদ্ধি হবে, তার মৃত্যু ঘটবে, তার বংশধররা যাত্রা অব্যাহত রাখবে একদিন গিয়ে সাহারায় পৌঁছাবে।
প্রায় দশ বছর গবেষণার পর বিবর্তনবাদ নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হবার পরও চার্লস ডারউইন তার গবেষণা প্রকাশ করেননি। তিনি আরও দশ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। ডারউইনের মতবাদ প্রকাশের পর দেখা গেল তার আশংকাই সঠিক ছিলো, তৎকালীন সময়ে তিনি প্রচণ্ড সমালোচিত হন এবং দৈনিক পত্রপত্রিকাগুলোতে বানরের সাথে তার বানরাকৃতি ছবি কিংবা বানরের শরীরে তার মাথা লাগিয়ে দিয়ে সেই ছবি নিয়মিত প্রকাশিত হত। অথচ তিনি কখনোই বলেননি মানুষ মানর থেকে এসেছে।
আজকাল অনেক শিক্ষিতজনও কৌতুক করে বলেন, “কই এত বছর পার হয়ে গেল একটি বানর তো আর জঙ্গল থেকে মানুষ হয়ে বের হয়ে এল না। আর কোন মানুষও তো বিবর্তিত রূপ পেল না”। হয়তো তারা জেনেশুনেই কৌতুক করেন পাছে তাদের ধর্ম বিশ্বাস মিথ্যে হয়ে যায়!
যাইহোক, পৃথিবীর সবকিছুই যে একই সূত্রে সৃষ্টি, একই ধারায় এসেছে তার প্রমাণ কিন্তু আজকাল সহজেই করা যায়। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের অসাধারণ আবিষ্কার হল, ডিএনএ বিশ্লেষণ। এই ডিএনএ বিশ্লেষণ করে সহজেই বলে দেয়া যায়, কে কার পিতা, পুত্র, ভাই, বোন বা বংশধর। বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের ন্যুনতম জ্ঞান আছে তারা সবাই জানি, ডিএনএ বিশ্লেষণ অব্যর্থ এবং প্রমাণিত।
এখন প্রশ্ন হল, পৃথিবীর সবকিছু যদি এককোষী প্রাণ থেকে তৈরি হয় তবে সবকিছুর ডিএনএ’তে তো মিল থাকার কথা। আছে কি সেই মিল?
হ্যাঁ আছে। বানর নিয়ে যখন সবাই কৌতুক করে তখন সবার আগে বানরের কথাই বলি। বানরের যতগুলো প্রজাতি আছে সবগুলোর সাথে মানুষের ডিএনএ’র মিল ৮০% থেকে ৯৮%। শিম্পাঞ্জির কথা যদি ধরি, শিম্পাঞ্জির ডিএনএ’এর সাথে মানুষের ডিএনএ’এর মিল ৯৮.৭%। বিশ্বাস হচ্ছে না? হাতের কাছেই গুগল আছে, গুগল করে জেনে নিন সঠিক তথ্য।
বিবর্তনবাদের সূত্র অনুযায়ী পৃথিবীর সকল প্রাণী একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তা যদি হয় তবে একটি কলার সাথেও আপনার ডিএনরএ’এর মিল থাকার কথা। আছে? হ্যাঁ আছে, মানুষের সাথে একটি কলার ডিএনএ’এর মিল ৫০-৬০%। গরু এবং মানুষের ডিএনএ মিল ৮০%, মানুষ এবং বিড়াল ৯০%। কোন প্রাণীর সাথে মানুষের ডিএনএ কতটুকু মিল তা গুগল করলেই সহজেই জানতে পারবেন তাই আর এ বিষয়ে লিখছি না।
মানব জাতির খুব কাছের পূর্বপুরুষ হোমো ইরগাস্টার, হোমো ইরেক্টাস, নিয়ানডার্থাল, হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস সহ আরো অনেক প্রজাতির ফসিল আবিষ্কার হয়েছে ও তা গবেষণা করা যাচ্ছে, ডিএনএ বিশ্লেষণ করা যাচ্ছে, ২০০বছর আগে ডারউইনের কাছে এইসব কিছুই ছিল না। তাই সহজেই অনুমান করা যায় কতটা কঠিন ছিল তার পক্ষে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
সবচেয়ে “কমন” একটি প্রশ্নের উত্তর সবশেষে দেই, এখন বিবর্তন হচ্ছে না কেন? ডারউইন নিজেই এর উত্তর দিয়ে গিয়েছিলেন, বিবর্তন এক অতি ধীর প্রক্রিয়া, মিলিয়ন বছরে তা সংগঠিত হয় এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বিবর্তন অনুধাবন অসম্ভব, এটি ঘটে এক-একটি প্রজাতি সমষ্টিগত ক্ষেত্রে। এই সমষ্টিগত পরিবর্তন দেখতে হলে মিলিয়ন বছর অপেক্ষা করতে হবে। পৃথিবীর সকল ধর্মের মানুষ ঘৃণাভরে প্রশ্ন করেন, “বানর থেকে মানুষ এখন হচ্ছে না কেন?” উত্তরটা আগেই দিয়েছি, বানর থেকে কোনকালেই মানুষ হয়নি।
প্রশ্ন হতে পারে, মানুষ বা বানরের পরিবর্তিত রূপ আমরা কেন দেখছি না? এই প্রশ্নের সাথে আরেকটি প্রশ্ন আপনি মিলাতে পারেন, আপনার শহরে একটি পিঁপড়া ছেড়ে দিয়ে আপনি অপেক্ষা করছেন এটি কোনদিন হেঁটে হেঁটে সাহারা মরুভূমিতে যাবে!!! ব্যাপারটা থিউরিটিক্যালি সম্ভব কিন্তু প্রাকটিক্যালি অসম্ভব। পিঁপড়া রওনা দিলে তার জীবদ্দশায় তার বংশবৃদ্ধি হবে, তার মৃত্যু ঘটবে, তার বংশধররা যাত্রা অব্যাহত রাখবে একদিন গিয়ে সাহারায় পৌঁছাবে।
সর্বশেষে বিবর্তনের একটি সহজ উদাহরণ দেই, ডাক্তাররা অযথা অসম্পূর্ণ কোর্সে এন্টিবায়োটিক খেতে নিষেধ করেন। কেন? কারণ আপনি যে ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে নির্দিষ্ট দিনে এন্টিবায়োটিক না খেলে তা এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা শিখে যাবে। সেই ব্যাকটেরিয়া নিজের শরীরে মিউটেশন ঘটাবে, পরিবর্তন আনবে, পরবর্তীতে আর ঐ এন্টিবায়োটিক আপনার শরীরে কাজ করবে না। এটিকে মেডিকেলের ভাষায় এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলে। এখন আপনার কাছেই প্রশ্ন, রোগ জীবাণু কি নিজেরা বিবর্তিত হচ্ছে না?
- এনামুল হক এনাম। চিকিৎসক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhetvoice.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করবে না।