জিসিক নির্বাচন বনাম আওয়ামী অহং

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন একটা কঠিন বার্তা। অবশ্য এরকম বার্তা আরো অনেকবারই পেয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা এগুলো খুব একটা আমলে নেন বলে মনে হয় না। জনমতের জন্য জনগণের উপর নির্ভরশীল না হয়ে তারা হয়তো পুলিশ, প্রশাসন এবং অন্যান্য আরো নানানকিছুর উপর নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। এই ব্যাপারে আমার জানা না থাকলেও বিষয়টি ভাবার এবং ধারণা করার যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ রয়েছে সাম্প্রতিক নানান ঘটনাপঞ্জির অবলোকন আর পর্যবেক্ষণে।

কয়েকদিন আগে আঞ্চলিক একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ঢাকার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে। সিলেট বিভাগে বাড়ি এরকম তিনজন মন্ত্রী সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সবার সাথে কম বেশি কথাবার্তা হল। আমি এধরণের অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলি ইদানীং। সবজায়গায় কেমন জানি একটা সামন্ততান্ত্রিক আচার-আচরণ। ক্ষমতাধরদের নগ্ন পদলেহন আমার গায়ে কাঁটা দেয় আর নিজের মধ্যে একধরণের দেউলিয়া মনোভাব তৈরি করে তাই যাইনা আমি। আর সংগঠনগুলোর উদ্দেশ্যের দিকে নজর না দিয়ে যখন দেখি পরিচালকেরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্বারে ব্রতী হয়ে উঠেন নিষ্ঠার সাথে সেটার কদর্যরূপ আমাকে এসব সংগঠনে অংশগ্রহণ থেকে বিরুপ করে তোলে।


প্রশাসন এবং দলীয় ক্যাডারনির্ভর নির্বাচনের স্বপ্ন যারা দেখেন, ক্ষমতা ভোগ করার যে কল্পনা তারা করেন তাদেরকে বলব, জনগণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করুন। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হউন। জনমত প্রভাবিত করার একমাত্র উপায় হল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, কমিটমেন্ট এবং দায়িত্ববোধ। আর সেটাকে মাথায় নিয়ে জনগণের কাছাকাছি থাকুন। মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গী হউন।


অনুষ্ঠানটিতে গিয়ে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, একটি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির আচরণ দেখে। একসময় একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অন্য একজন প্রার্থীর কাছে উনি হেরে যান চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে। তখনো তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এত উগ্র এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ মানুষ করতে পারে সেটা ভেবে কূলকিনারা পাইনি পুরো সময়টাতে। গুণীজন সংবর্ধনায় উনার অপছন্দের সম্ভবত একজন ছিলেন। ঐ গুণীর ক্রেস্ট বিতরণের সময় উনি বসা থেকে দাঁড়ালেনও না। উনার কার্যকলাপ আচার-আচরণ নিয়ে দূর থেকে সবসময় নানান গল্প শুনি। তাই উনার মুখোমুখি বা সামনাসামনি আমি কখনো হইনা। অনুষ্ঠানের দর্শক সারিতে বসে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম উনার আচার-আচরণ। আর বারবার বিস্মিত আর অনুতপ্ত হচ্ছিলাম।

বসে বসে ভাবছিলাম এইসব আচার-আচরণে সম্ভবত উনি একা চ্যাম্পিয়ন নন। মাঠপর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ, হাবভাব, ভাবভঙ্গি হয়ত এরকমই। সংবাদ মাধ্যম থেকে এরকম আচার ব্যবহারের নানান গল্প আমরা নিয়মিত শুনতে পাই। বিভিন্ন পর্যায়ের দলীয় নেতারা হয়তো নিজেদেরকে মালিকপক্ষ ভাবা শুরু করেছেন। জনগণ এখানে প্রজা বা তাদের দয়া দক্ষিণায় বেঁচে থাকা মানুষ। আর তাই নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ পেলে তারা নিশ্চিত হয়ে যান তারা বিজয়ী হয়ে গেছেন বলে।

প্রশাসন এবং দলীয় ক্যাডারনির্ভর নির্বাচনের স্বপ্ন যারা দেখেন, ক্ষমতা ভোগ করার যে কল্পনা তারা করেন তাদেরকে বলব, জনগণের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করুন। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হউন। জনমত প্রভাবিত করার একমাত্র উপায় হল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান, কমিটমেন্ট এবং দায়িত্ববোধ। আর সেটাকে মাথায় নিয়ে জনগণের কাছাকাছি থাকুন। মানুষের সুখ দুঃখের সঙ্গী হউন।

ঝুট ব্যবসা করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা জাহাঙ্গীরকে কেনইবা গাজীপুরের মত গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল আগেরবার সেটা আমাদের জানা নেই। কারাই বা আগেরবার তাকে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন সেটাও আমাদের জানা নেই। আর কেনই বা পরবর্তীতে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, মেয়রের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল সেটাও আমাদের জানা নেই। কি প্রক্রিয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছিল, তার বক্তব্য শোনা হয়েছিল কিনা, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছিল কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন তো রয়েছেই। সংবাদমাধ্যমে জাহাঙ্গীর এসে বারবার অনুযোগ করেছেন যে তার কথা শোনেননি কেউ। দলীয় প্রধানের সাথে দেখা করার শত চেষ্টা করে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন একাধিক বক্তব্যে যা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এবার নির্বাচনে জাহাঙ্গীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে চেয়েছেন। তার মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়ন বাতিলের যুক্তিটি খোঁড়া ছিল, নাকি শক্তিশালী ছিল সেটা বিচার করার দায়িত্ব আমাদের না। তবে জাহাঙ্গীর অত্যন্ত বুদ্ধিমান আর চতুর একজন মানুষ এ ব্যাপারে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। আমার ধারণা, রাজনীতির মাঠে তিনি অত্যন্ত পারদর্শী এবং কৌশলী। তার প্রমাণ উনি অনেকটা অখ্যাত আর সাধারণ একজন মানুষ, তার নিজের মাকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়ে রাজধানী ঢাকার পার্শ্ববর্তী এই গুরুত্বপূর্ণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে জিতিয়ে এনেছেন। এই নির্বাচনে সরকার এবং পুরো প্রশাসনযন্ত্র জাহাঙ্গীর এবং তার মা জায়েদা খাতুনের বিপক্ষে অবস্থান করবেন এটাই স্বাভাবিক। এই বৈরী পরিস্থিতিতে জায়েদা খাতুনের জয় এটা একটা সতর্কবার্তা। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি কঠিন সতর্কবার্তা।

যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনের একজন বিরোধী। স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকমুক্ত হোক। স্থানীয় সরকার দলীয় প্রভাবমুক্ত হোক। সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার চাওয়া।

সাধারণ জনগণের মনের কথাটা প্রিয় দলের নেতারা শুনুন, প্লিজ। আপনাদের কাছে যেভাবে তথ্য পৌঁছায় সেটাতে ঘাপলা আছে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। অথবা আপনাদের কাছে তথ্য আছে কিন্তু আপনারা একগুঁয়ে। আপনাদের ভিতরে হয়তো এক ধরনের অহংকার ঢুকে গেছে। অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন আপনারা।

আমরা ছোটবেলায় ভাব সম্প্রসারণ শিখেছি, ‘অহংকার পতনের মূল’।

বহেরুগ্রাম
২৬ মে ২০২৩

মুহম্মদ আব্দুস সামাদ। উন্নয়নকর্মী।