সুরমা নদীর তীরে সিলেট শহর গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় টিলা ভূমি নিয়ে। গত তিন দশকে সে শহর নগরে উন্নিত হয়েছে, কিন্তু এ জনপদের স্বকীয়তা বিনষ্ট করে পুরো নগর প্রায় সমতল করে ফেলা হয়েছে। এখন আর নগরে টিলা খুঁজেই পাওয়া যায় না। নগর এখন প্রায় সমতল। টিলা কাটার মধ্য দিয়ে নগরের বাস্তুতন্ত্রকে দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। এক সঙ্গে হয়েছে দুটি অপরাধ। টিলা কেটে টিলার মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে জলাধার, পুকুর-দিঘি।
সিলেট নগরে টিকে থাকা যৎসামান্য টিলাগুলোর অবস্থান দেখলে ধারণা করা যায় এ শহরের অতীত। মাত্র চার দশক পূর্বেও সিলেট ছিল ছোট-বড় টিলার শহর। গত তিন দশকে নির্বিচারে কেটে সাবাড় করা হয়েছে টিলাগুলো। সমতল নগরে কিছু ধর্মীয় স্থাপনা, কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং কিছু সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবন থাকার কারনে হাতেগোনা কিছু টিলা হারাধনের ছেলের মতো বিক্ষিপ্তভাবে টিকে আছে। টিকে থাকা হাতেগোনা এ সকল টিলা ও টিলার খণ্ডিত অংশই এ নগরের অতীত ভৌগলিক স্বকীয়তা এখনও জানান দিচ্ছে।
সিলেট নগরের প্রাণকেন্দ্র যদি হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর দরগাহকে ধরে নেয়া হয়, তবে সেই কেন্দ্রটি একটি টিলাতে অবস্থিত। এর ঢালজুড়ে রয়েছে দরগাহ’র গোরস্থান। দরগাহ’র দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ব্রিটিশ আমলে স্থাপিত জেলা পুলিশ লাইন কয়েকটি টিলা নিয়েই গড়ে উঠেছে। পুলিশ লাইন থেকে সামান্য দক্ষিণে ছোট একটি টিলায় হযরত মধু শহীদ (রহঃ) এর মাজার। এ মাজার থেকে ওসমানী মেডিকেলের দিকে মাত্র ৪০০ মিটার পশ্চিমে কাজলশাহ এলাকায় রয়েছে যুগল টিলা আখড়া (ইস্কন মন্দির)।
ওসমানী মেডিকেলের পশ্চিম দিকে বাগবাড়ি এলাকায় রয়েছে নরসিংহ টিলা বা মরার টিলা। সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সামান্য দূরে সুরমা নদীর কাছেই ‘ঘাসিটুলা ঈদ্গাহ’র অবস্থান দেখলেই বোঝা যায় এটি টিলাভূমি ছিল। এর পাশে আর কোনো উঁচু ভূমি না থাকলেও নওয়াব রোডে জেলা পরিষদ ডাকবাংলো লাগোয়া রেঞ্জ রিজার্ভ পুলিশের কমান্ডেন্টের বাংলো টিলাতে স্থাপিত। এই টিলা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে কুয়ারপাড়ে হযরত সৈয়দ লাল (রহঃ) এর মাজার একটি টিলার অংশ। রিকাবীবাজারে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে এক সময় লুসাই সম্প্রদায়ের গীর্জাঘর ও সমাধিস্থল টিলাভূমিতেই ছিল। গত তিন দশকে তা নিশ্চিহ্ন হয়েছে।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর দরগাহ’র দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা মাঠের লাগোয়া সিভিল সার্জনের কার্যালয় টিলাভূমিতে। এ টিলার পূর্ব দিকে রাজা গৌড়গোবিন্দের টিলা। যা বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজের বাসভবন। এখানে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলীদের বাসভবনও রয়েছে। এ টিলার পূর্ব প্রান্তে আরও কিছু ছোট টিলা রয়েছে। যা মিরবক্সটুলা ও কাজিটুলা পর্যন্ত বিস্তৃত। কাজিটুলা উঁচা সড়কের হিল ভিউ কনভেনশন সেন্টার একটি টিলার অংশ। সিলেট নগরের মধ্যে টিলা ভূমিতে নির্মিত একমাত্র টিকে যাওয়া বেসরকারি আসাম প্যাটার্নের বাংলো হচ্ছে উঁচা সড়কের এসপি টিলা।
মিরবক্স টুলার পাশেই নয়া সড়কে প্রেসবিটারিয়ান চার্চ, যা একটি টিলাভূমিতে অবস্থিত। এই চার্চের পশ্চিম প্রান্তে একটি টিলার ঢালেই ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হাদা মিয়া-মাদা মিয়ার সমাধি। চার্চের পূর্ব দিকে কিশোরী মোহন বালিকা বিদ্যালয়ের পেছনে শাহ চান্দ গলি। এখানে একটি টিলার অংশে হযরত শাহ চান্দের মাজার। বন্দর বাজার ও জেল রোডের সংযোগ স্থলে হযরত আবু তোরাব মসজিদ ও মাজার চত্বরের ভিটার উচ্চতা দেখলে অনুমান করা যায় এখানেও উঁচু ভূমি ছিল।
নয়াসড়ক মোড় থেকে কুমারপাড়ার একাংশ নিয়ে হযরত মানিক পীর (রহঃ) এর মাজার। এই মাজার সংলগ্ন টিলা ভূমিতে বর্তমানে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কবরস্থান। মানিক পীর টিলা সিলেট নগরের ভেতরে থাকা সবচেয়ে উঁচু স্থান। মানিক পীর টিলার দক্ষিণে বর্তমানে যেখানে রোটারি ও লায়ন’স ক্লাবের হাসপাতাল, সেখানে ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতিধন্য খেলাফত টিলা। যার কোনো অস্তিত্ব আর নেই।
মানিক পীর টিলার দক্ষিণে কাজিটুলা ও শাহী ঈদগাহ এলাকাতেই বাংলাদেশ টেলিভিশনের সম্প্রচার কেন্দ্র একটি টিলায় অবস্থিত। যার পূর্ব ঢালের কিছু অংশে রয়েছে খ্রিস্টান কবরস্থান। এর পূর্ব প্রান্তে কাজি জালাল উদ্দিন স্কুল একটি টিলাতেই প্রতিষ্ঠিত। এই স্কুল টিলার পূর্ব প্রান্তে কুমারপাড়া ঝর্ণারপাড়ে ছোট টিলায় হযরত সৈয়দ হামজা (রহঃ) এর মাজার। কাজি জালাল উদ্দিন স্কুল থেকে দক্ষিণ দিকে কুমারপাড়ায় সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর ব্যক্তিগত কার্যালয় পর্যন্ত এলাকা টিলাভূমির অংশ। হযরত সৈয়দ হামজা (রহঃ) এর মাজার থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ৫০০ মিটার দূরে রায়নগরে ব্রজনাথের টিলা। এই টিলাভূমির সাথেই রয়েছে সোনাতলা দিঘি। ব্রজনাথের টিলা থেকে সামান্য উত্তরে আবহাওয়া অফিস একটি টিলাভূমি। রায়নগর রাজবাড়ি জামে মসজিদের পেছনে থাকা টিলাতে একটি আবাসিক ভবন রয়েছে। রায়নগর এলাকা প্রায় সমতল হয়ে গেলেও ‘মিতালী আবাসিক এলাকা’ নামে নগরের সবচেয়ে উঁচু বেসরকারি আবাসিক এলাকা এখানেই গড়ে উঠেছে। এই আবাসিক এলাকার উত্তর-পূর্ব দিকে বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন থেকে পূর্ব দিকে গেলে সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল। এই হাসপাতাল ও এর চারপাশে ছোট-বড় টিলার চিহ্ন দৃশ্যমান হলেও এখানেও অনেক টিলা সমতল করে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠেছে। আরামবাগ আবাসিক এলাকার অধিকাংশ ভূমি টিলা কেটেই সমতল হয়েছে। এখানকার উঁচু-নিচু সড়ক সে সাক্ষ্য বহন করে। বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের পেছনের বিশাল এলাকা বালুচর নামে পরিচিত। এই এলাকাটিতে এক সময় ওঁরাও সম্প্রদায়ের বসতি ছিল। এখনও ওঁরাওদের হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার টিকে আছে চন্দন টিলায়। এখানে এখনও অর্ধেক কাটা অনেক টিলা রয়েছে।
বালুচর মোড়ে দুর্গা মন্দির একটি সুউচ্চ টিলাতে প্রতিষ্ঠিত। দুর্গা মন্দিরের দক্ষিণ প্রান্তে রায়নগরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকা। এখানে মদিনাবাগ আবাসিক এলাকায় এখনও একটি টিলাভূমি টিকে আছে। দর্জিবন্দ, খরাদিপাড়া, সেনপাড়া, ঝেরঝেরি পাড়া, ঝর্নারপাড়সহ রায়নগর এলাকার অনেক রাস্তা ও বাড়ির উঁচু ভিটা জানান দেয় অতীতে এখানেও টিলাভূমি ছিল। রায়নগর পয়েন্টে একটি বাড়ির নাম এখনও টিলা বাড়ি।
বালুচর দুর্গা মন্দির থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজ। এই কলেজের অধ্যক্ষের বাংলোর নাম থ্যাকারের টিলা। কলেজের আর্টস বিল্ডিং ও দাপ্তরিক ভবন টিলাতেই প্রতিষ্ঠিত। কলেজের বাংলা বিভাগের নতুন ভবনের পেছনের টিলাতে ছিল রাজা গৌড় গোবিন্দের অন্যতম দুর্গ। সুউচ্চ টিলার উপর দুর্গটির অবস্থানের কারণে এটির নাম রাখা হয়েছিল ‘টিলাগড়’। এখানে এখনও একটি ফটক ও ভবনের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এ টিলাগড়ের নামেই বৃহত্তর ওই এলাকার নাম হয়েছে টিলাগড়। তবে এটি রাজা গৌড় গোবিন্দের দুর্গ হলেও বর্তমানে অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। অনেকের কাছে এটি একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে পরিচিত। এমসি কলেজের পাশেই গোপাল টিলার অবস্থান।
টিলাগড় থেকে শাপলাবাগ এলাকায় দুই দশক পূর্বেও টিলাভূমি ছিল। এখন নেই। আলুরতল এলাকার সংরক্ষিত বনাঞ্চল এখন টিলাগড় ইকোপার্ক। টিলাকেন্দ্রিক রিজার্ভ ফরেস্টের ১১২ একর জায়গা নিয়ে ২০০৬ সালে টিলাগড় ইকোপার্ক স্থাপন করা হয়। টিলাগড় ইকোপার্কের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রতিনিয়ত টিলা কাটা চলছে। মাদানী নগর আবাসিক এলাকা, বাগমারা এলাকার অনেকাংশ গড়ে উঠেছে টিলা সমতল করে। আলুতল এলাকাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৬ সালে ৫০ একর জমি নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ ভূমি ছিল টিলাশ্রেণির। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ‘সূর্যালোকে বর্ণমালা’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে প্রায় ৩০ ফিট উচ্চতার টিলা সংরক্ষণ করে। যদিও ২০১৪ সালে ছাত্রাবাস নির্মাণের দোহাই দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি টিলা কাটে এবং জলাধার ভরাট করে। যে টিলাটি কাটা হয়েছে তা ক্যাম্পাসের সবচেয়ে বড় টিলা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই এটাকে ‘বিরল প্রজাতির গাছের সংরক্ষণ টিলা’ হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। ২০০৯ সালে এই টিলায় স্থাপন করা হয়েছিল ‘অ্যাগ্রো ফরেস্ট জার্ম প্লাজম সেন্টার’। পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত সরকারি ছাগল খামার ও গরুর ফার্ম টিলা ভূমিতেই গড়ে তোলা হলেও সেখানেও টিলা বিনাশ হয়েছে। সম্প্রতি ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত দুগ্ধ খামারের পাঁচ একর জায়গাতে পাঁচটি টিলার অনেকাংশ সমতল করে নির্মাণ করা হচ্ছে প্রাণিসম্পদ ইন্সটিটিউট।
দরগা-ই-হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর উত্তর-পূর্ব প্রান্তে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরত্বে লাক্কাতুড়া ও মালনীছড়া চা-বাগানের অবস্থান। প্রায় অর্ধ সহস্র ছোট-বড় টিলাতে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয় বাগান দুটি। মালনীছড়া হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম চা-বাগান। ইংরেজ সাহেব হার্ডসনের হাত ধরে ১৮৫৪ সালে ১৫০০ একর জায়গাজুড়ে এই বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাগানের একটি টিলা হযরত শাহজালাল (রহঃ) ও ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতিধন্য। প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী লাকড়ি তোড়ার উৎসব এখানকার একটি নির্দিষ্ট টিলাতে অনুষ্ঠিত হয়।
মালনীছড়া চা-বাগান এখন ব্যক্তি মালিকানাধীন। এ বাগানের ভেতরে টিলা কাটার ঘটনার লেখক প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ২০১৮ সালের ১০ মার্চ টিলা কাটার ছবি তোলায় পরিবেশবাদী ও সংবাদকর্মীদের আটক করে বাগান কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে প্রশাসনের উপস্থিতিতে আটককৃতদের সসম্মানে ছেড়ে দিলেও টিলা কাটার প্রমাণ দেখে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দায়ের করে। টিলা কাটার দায়ে মালনীছড়া চা-বাগানকে পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অ্যান্ড অ্যানফোর্সমেন্ট উইং ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে। মালনীছড়া বাগানের অভ্যন্তরে পরবর্তীতেও টিলা কেটে সানশাইন প্লে গ্রাউন্ড বানানো হয়েছে। মালনীছড়ার ফাঁড়ি বাগান তেলিহাটি। তেলিহাটি চা-বাগানের উত্তরাংশে দেদারসে টিলা কাটা চলছে। ওসমানী বিমানবন্দর ও সিলেট-কোম্পানীগঞ্জ সড়কের দক্ষিণাংশে কেওয়াছড়া চা-বাগানের নিকটবর্তী কাকুড়পাড় এলাকাতে দেদারসে টিলা কাটা হয়েছে। এখানে সরকারি খাস জায়গা দখল করে বসতি নির্মাণের অভিযোগ আছে। ওসমানী বিমানবন্দরের সীমানাতে এখনও অনেক টিলা আছে।
ন্যাশনাল টি কোম্পানির অধীন লাক্কাতুড়া চা-বাগানের অনেক টিলাভূমি বেদখল হয়ে নগর বর্ধিত হয়েছে। চৌকিদেখী, খাসদবীর এলাকার পূর্ব প্রান্ত এবং গোয়াইপাড়া, কলবাখানী ও হাজারীবাগের উত্তর প্রান্তের অনেক বাসা-বাড়ি লাক্কাতুড়া ও দলদলি চা-বাগানের টিলা কেটে বানানো হয়েছে। লাক্কাতুড়া গলফ ক্লাব এলাকায় প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠাকালেও টিলাভূমি সমতল করা হয়েছে। সর্বশেষ আউটডোর স্টেডিয়াম বানানো হয়েছে টিলা সমতল করেই।
হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর দরগাহ’র উত্তর প্রান্তে সবচেয়ে কাছের টিলা ভূমি হচ্ছে আম্বরখানা কলোনি এলাকা। ষাটের দশকে পাকিস্তান সরকারের আমলে আম্বরখানা সরকারি কলোনি নির্মাণ করা হয় মজুমদার পরিবারের টিলাভূমি অধিগ্রহণ করে। যা মূলত গড়দুয়ারা এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। আম্বরখানা কলোনির দক্ষিণের দত্তপাড়া আবাসিক এলাকাটিও কলোনির সেই টিলা ভূমির অংশ। আম্বরখানা কলোনির উত্তর দিকে গদার টিলা। এখানে হযরত শায়েখ পীর (রহঃ) এর মাজার। যা শুধু নামেই গদার টিলা। চারপাশের বসতি দেখলে ধারণা করা অসম্ভব এখানে কখনও টিলা ছিল!
মজুমদার বাড়ি দিঘির উত্তর প্রান্তে চাঁনঘাটে একটি ছোট টিলাতে রয়েছে সাত পীরের মাজার। এই মাজারের স্থাপনা দেখলে বিশ্বাস করতে হবে এটি একটি টিলাভূমি। মজুমদারীতে বিমান অফিসের পূর্ব দিকের ‘খান বাড়ি’ টিলা ভূমিতেই ছিল। এখনও কিছু বাসার মূল ভিটা দেখলে বোঝা যায় যে এটি টিলার অংশ।
আম্বরখানার পূর্বে বড়বাজার এলাকায় মণিপুরিদের বসতিসহ অনেক ভিটেবাড়ির উচ্চতা জানান দেয় টিলাভূমির অস্তিত্ব। এখানে হযরত কালা শাহ (রহঃ) এর মাজার উঁচু ঢিবিতে অবস্থিত। ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই গেটের বিপরীতে চলে যাওয়া আবাসিক এলাকার শেষ প্রান্তে ছিল যুগাইটিলা। যা গত দেড় দশক পূর্বে বিনাশ করা হয়েছে। কলবাখানীতে হযরত চাষনী পীর (রহঃ) এর মাজারের টিলাটি দর্শনার্থীদের পছন্দের স্থান। এ টিলায় শতাধিক বানরের বসবাস। এ টিলার পাশের টিলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলোনি। এ কলোনি থেকে সামান্য দূরেই শাহী ঈদগাহ এলাকার সুউচ্চ একটি টিলাতে সিলেট বন বিভাগের অতিথিশালা। মোগল আমলে নির্মিত শাহী ঈদগাহ টিলা ভূমিতেই নির্মিত।
দরগা-ই-হযরত শাহজালাল (রহঃ) এর উত্তর দিকে ষাটের দশকে গড়ে ওঠা সিলেট নগরীর সবচেয়ে আধুনিক আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেট। হাউজিং এস্টেটের ৫ নম্বর লেনের ৫২ নম্বর বাসার একাংশে একটি ছোট টিলার চিহ্ন ছিল। যা নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কেটে ফেলা হয়। হাউজিং এস্টেটের ১ ও ২ নম্বর লেনের অবস্থান অন্য লেন থেকে উঁচুতে। ২ নম্বর সড়কের ৭ নম্বর ও ৮ নম্বর লেনের মধ্যবর্তী কিছু বাসার অবস্থান উঁচুতে। ধারণা করা যায় এখানেও একসময় টিলা ভূমি ছিল। হাউজিং এস্টেটের ২ নম্বর সড়ক থেকে মজুমদারীর দিকে যাওয়া রাস্তা অন্তত ১০ ফুট উচ্চতায় উঠেছে। অর্থাৎ মজুমদারি এলাকাটি টিলা কেটেই সমতল করা। হাউজিং এস্টেটের উত্তরে পশ্চিম পীর মহল্লা, বাদাম বাগিচা, বন কলাপাড়া এলাকা আশির দশকেও টিলাবেষ্টিত ছিল। উত্তর পীর মহল্লা বা পাহাড়িকা আবাসিক এলাকাতে আশির দশকেও টিলা ছিল। এখানে ব্যক্তি মালিকানার টিলাগুলো সমতল করা হয়েছে। বনকলা পাড়া এলাকায় হযরত শাহ রুমি (রহঃ) এর মাজার এখনও টিলার চিহ্ন বহন করে টিকে আছে।
তারাপুর ও আলি বাহার চা-বাগানের টিলার খতিয়ান তল্লাশি দেয়া হলে টিলা বিনাশের বহু আখ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে। সিলেটের আলোচিত সমালোচিত বিত্তশালী ব্যবসায়ী রাগীব আলীর দখলে থাকাকালীন সময়ে তারাপুর চা-বাগানের টিলা ভূমিতেই নির্মাণ করা হয় রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। চা-বাগানের ফ্যাক্টরির কাছের টিলাতে নির্মাণ করা হয়েছে কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের হল। তারাপুর ও আলি বাহার চা-বাগানের আশপাশের বেশ কিছু আবাসিক এলাকা যেমন- পাঠানটুলা, আখালিয়া, কালিবাড়ি, ব্রাহ্মণ শাসন, যুগীপাড়া, হাওলাদারপাড়া, করের পাড়া, নয়াবাজার, ডলুয়া, বড়গুল, কোরবান টিলা আবাসিক এলাকা, গুয়াবাড়ি এলাকাতে গত দুই দশকে অসংখ্য টিলা বিনাশ করা হয়েছে।
হাওলাদারপাড়ার মজুমদার টিলাতে একাধিক মামলা ও জরিমানা করা সত্ত্বেও টিলা কাটা বন্ধ করা যায়নি। এখানে দুসকি ও জাহাঙ্গীর নগর নামের দুটি আবাসিক এলাকা গত এক দশকে গড়ে উঠেছে তারাপুর ও আলি বাহার চা-বাগানের টিলা ভূমি বিনাশ করে।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল টিলা ও জলাভূমি নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যানে টিলা রক্ষা করেই ভবন নির্মাণের কথা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে একটি টিলার কিছু অংশ কেটে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার একটি সুউচ্চ টিলাতে নান্দনিক স্থাপত্যশৈলীতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। যা সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সিলেট নগরের পাহাড়-টিলা সংক্রান্ত এ তথ্য পড়ে পাঠকমাত্র ধারণা করতে পারবেন সিলেট জেলা ও সিলেট বিভাগের পাহাড়-টিলার অবস্থা। এ লেখায় জেলা ও বিভাগের পাহাড়-টিলা বিনাশের গল্প যুক্ত করলে লেখার কলেবর বাড়বে। তবে জেলা ও বিভাগের সামগ্রিক অবস্থা সিলেট মহানগরের থেকে ভালো। তাই সিলেট নগরের চারপাশের এই চিত্র থেকে ধারণা নিয়ে সিলেট জেলা ও বিভাগে টিকে থাকা পাহাড়-টিলা রক্ষায় মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সিলেট।