দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি করে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এই পরিকল্পনার আওতায় দেশীয় গ্যাস কোম্পানিগুলোকে আরও বেশি অনুসন্ধান ও উত্তোলনের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকটের মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জ্বালানি সংস্থানের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্য দেশে যখন জ্বালানি সংকট চলছে তখন বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় সাশ্রয়ের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের মতোই জ্বালানি খাতের কাজের অগ্রগতি বাড়াতে চায় সরকার। এজন্য আলাদা আলাদাভাবেই জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান প্রকল্প ও কাজের অগ্রগতির বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে যাতে করে প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে যায়। এমন এক পরিস্থিতিতে আজ ৯ আগস্ট (মঙ্গলবার) বাংলাদেশে পালিত হতে যাচ্ছে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস।
ইতিহাস
১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েলের কাছ থেকে তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ এবং কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নেন। ওই সময়ে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে গ্যাসক্ষেত্রগুলো কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শিতাকে স্মরণে রাখতে প্রতিবছর এই দিনে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করা হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০১০ সালে ৯ আগস্টকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
জ্বালানি নিরাপত্তায় চলমান কার্যক্রম
গ্যাস অনুসন্ধান ও এলএনজি:
সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীকাইল ইস্ট-১ এবং জকিগঞ্জ-১ নামে দুইটি নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া সিলেট-৯ কূপ খনন কাজ শেষ হয়েছে এবং বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য গ্যাস পাওয়া গেছে। এছাড়া ৫টি কূপ খনন প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ৬টি কূপের ওয়ার্কওভার শেষ হয়েছে।
নতুন পাইপলাইন ও কমপ্রেসর স্থাপন:
এর বাইরে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে ১৯টি ওয়েলহেড কমপ্রেসর স্থাপন, চুরি বন্ধে ৪ লাখ ৭০ হাজার গ্যাস প্রিপেইড মিটার স্থাপন, নতুন গ্যাস অনুসন্ধানে ২ডি/৩ডি সাইসমিক জরিপ করা হচ্ছে।
এলএনজি:
মহেশখালীর মাতারবাড়িতে এলএনজি টার্মিনাল ডেভেলপার নির্বাচন, স্পটভিত্তিতে এলএনজি আমদানির পাশাপাশি ওমান ও কাতার থেকে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে।
সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান:
সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে (গভীর-অগভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান) এবং (অফশোর বিডিং রাউন্ডের জন্য প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) হালনাগাদ করা হচ্ছে।
জ্বালানি তেল:
গত ২০০৯ সাল হতে জুন ২০২২ পর্যন্ত বিগত ১৩ বছরে জ্বালানি তেলের মজুত ক্ষমতা ৮.৯৩ লাখ মেট্রিক টন হতে ১৩.০৮ লাখ মেট্রিক টনে অর্থাৎ ৪.১৫ লাখ মেট্রিক টন বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা দেশের প্রায় ৪০-৪৫ দিনের জ্বালানি চাহিদা পূরণে সক্ষম। তাছাড়া, বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর আওতায় আরও ২,৫৮,৮০০ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল মজুত ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চলমান রয়েছে। এর ফলে জ্বালানি তেল মজুতের সক্ষমতা প্রায় ৪৫-৫০ দিনে উন্নীত হবে। জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে দ্রুত, সহজ, নিরাপদ ও ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে পরিবহনের জন্য মোট ৬২০ কিলোমিটার জ্বালানি তেল পাইপ লাইন স্থাপন কাজ চলমান রয়েছে। আমদানিতব্য অপরিশোধিত ক্রুড অয়েল ও পরিশোধিত ডিজেল স্বল্প সময়ে নিরাপদে ও ব্যয় সাশ্রয়ীভাবে খালাস ও পরিবহনের জন্য সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের আমদানিনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে ৩০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ইআরএল ইউনিট-২ স্থাপন করার লক্ষ্যে প্রকল্প অনুমোদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
কয়লা ও অন্যান্য খনিজ:
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতর (জিএসবি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। জিএসবি কর্তৃক আবিষ্কৃত খনিজ সম্পদগুলোর মধ্যে কয়লা অন্যতম, যা মূলত বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। জিএসবি মোট চারটি কয়লা ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে যথা: জয়পুরহাট জেলার জামালগঞ্জ (১৯৬২ সালে), দিনাজপুর জেলার বড়পুকুরিয়া (১৯৮৫ সালে), রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলাধীন খালাশপীর (১৯৮৯ সালে) এবং দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলাধীন দীঘিপাড়া (১৯৯৫ সালে)।
এরমধ্যে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি থেকে আগামী ৬ বছরে ৪.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যে চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছে। এদিকে পাথর উত্তোলনে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির সাথে জার্মানিয়া-ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি)-এর চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া দিনাজপুরে একটি এলাকায় লৌহ আকরিকের সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য কিনা তা নিয়ে এখন কাজ চলছে।
মতামত
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সংকট দেখা দিয়েছে। ডলারের দাম এখন অনেক বেশি। জ্বালানির দামও বাড়ছে। স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি এই কারণে আপাতত আমদানি করা যাচ্ছে না। আর একদিনে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমরা আমাদের কাজ আগের চেয়ে অনেক বেশি জনবল এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করে যাচ্ছি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, বিশ্ববাজারে যে সংকট তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে হলে আমাদের দেশীয় জ্বালানিতে জোর দিতে হবে। এজন্য বিদ্যুৎ খাতের মতো এবার জ্বালানি খাতকেও বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। আমদানিনির্ভরতা হয়তো এখনই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। আরও আগেই আমাদের দেশীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেওয়া উচিত ছিল। এখনও সময় আছে, আমাদের কাজের গতি বাড়াতে হবে।
অনুষ্ঠানসূচি
দিবসটি উপলক্ষে জ্বালানি সেক্টরের সাম্প্রতিক অর্জন, অগ্রগতি ও অন্যান্য বিষয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবের বাণী প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস, ২০২২ উদযাপন উপলক্ষে ভার্চুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন করেছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী যুক্ত হবার কথা রয়েছে।