হৃদয়ের গভীরে জীবনের উঠোন জুড়ে থরে থরে স্বপ্নের আল্পনা সাজিয়ে ঠিক সাড়ে এগারো বছর আগে দাম্পত্য জীবনে পা রেখেছিলেন দরিদ্র হেলাল আহমদ (৩৫) ও খাদিজা বেগম (৩০)। যাপিত জীবনে সুখের চাষ করতে না করতে দরিদ্রতার মাঝেই বিয়ের দেড় বছরের মাথায় এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয় এ দম্পতির ঘরে। নাম রাখা হয় মীম আক্তার। এর পরে জন্ম হয় মাহিয়া আক্তার (৬) ও ফারিহা আক্তার (৩)-এর। মীম নামের দশ বছরের এ শিশু মেয়েটি সলফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। মেঝ মেয়ে মাহিয়া একই বিদ্যালয়ের ১ম শ্রেণিতে পড়ছে। দারিদ্রতাকে ঠেলে কঠোর পরিশ্রম করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলো পরিবারটি, তখনই বাঁধে বিপত্তি।
স্ত্রী খাদিজা বেগম জানান, ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কোনো সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছেন না। তবু ভালোই চলছিলো সবকিছু।
বলেন, ‘তিনি (খাদিজার স্বামী) কাজে গেলে খেয়েছি, না গেলে উপোষ থেকেছি। না হলে বাবার বাড়ি থেকে এনে সন্তানদের খাইয়েছি। গত ক’বছর ধরে বাচ্চাদের বাবার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হতো লাগলো। ধীরে ধীরে এর মাত্রা বাড়তে থাকে। মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। চলাফেরা দেখলে বুঝবার উপায় নাই যে তিনি একজন মানসিক রোগী, কিন্তু মাঝে মাঝে আচরণ খুবই অস্বাভাবিক লাগে। তাছাড়া মূল সমস্যা হচ্ছে তিনি কোনো ধরণের কাজে যেতে পারেন না। মানসিক সমস্যার কারণে অনেকে কাজে নিতেও চান না। মানুষের ফরমায়েশি খাটেন। কেউ টাকা দিলেও খাটেন, না দিলেও খাটেন। আমি আছি বড্ড জ্বালায়। মাঝে মাঝে মন চায় সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই। পারি না তিনটা মেয়ের কথা ভেবে।’
হেলাল আহমদ সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের সলফ পূর্বপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি মরহুম আশকর আলীর ছেলে।
আশকর আলীর স্ত্রী জানান, শ্বশুরের রেখে যাওয়া কোনো বসতভিটাও তাদের নেই। তার স্বামীর নানা-নানীর দেওয়া জায়গাটিই এখন একমাত্র সম্বল হেলাল আহমদের। এ ভিটাতে টিনশেডের একটি ঘর তাদের। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার-মেরামত না করায় নড়বড়ে ছিলো ঘরটি। ২০২০, ২০২১ ও সর্বশেষ ২০২২ সালে ভয়াবহ বন্যায় বসতঘরটি একেবারে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তিন কন্যা সন্তান, স্ত্রীকে নিয়ে রীতিমতো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। শীত চলে এসেছে। এ অবস্থায় কীভাবে দিন-রাত্রি যাপন করবেন এ দুঃশ্চিতায় সময় কাটে পরিবারটির।
মঙ্গলবার দুপুরে হেলাল আহমদের বাড়িতে গিয়ে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সলফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রায় দুইশো মিটার পূর্বে, মৌগাঁও-সলফ সড়কের উত্তরপাশে, সলফ পূর্বপাড়ায় জরাজীর্ণ, পুরো ভাঙ্গা অবস্থায় হেলাল মিয়ার বসত ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের মূল অংশের সামনের বেড়া নেই, খসে পড়েছে। চালে একটি টিনও নেই। দক্ষিণ দিকের যে বেড়াটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই বেড়ার একটি টিনও আস্ত নেই। কোথাও ভাঙ্গা, কোথাও ঝং ধরা ছোটো ছোট ছিদ্রে ভরা। আপাতত এখনো দাঁড়িয়ে আছে পেছনের দিকের সংযুক্ত একচালা ঘর (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ছাফটা)। চার-ছ’হাতের এ ঘরটিতেই এখন থাকা, খাওয়া, রান্না-বান্না সবকিছু। একমাত্র ঘরটিরও নেই দরজা, জানালা। ‘ছাফটা’ চালে আছে অসংখ্য ভাঙ্গা আর ছিদ্র।
হেলাল আহমদের পরিবারের বিষয়ে কথা হয় এলাকার একাধিক শিক্ষক, নবীন, প্রবীণ ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে। তারাও জানান হেলাল আহমদের অসহায়ত্ব, হঠাৎ করে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়া ও দারিদ্রতার অদ্যোপ্রান্ত। প্রতিবেদককে দেখে অনেকেই অনুরোধ করেছে, যেনো প্রতিবেদনটি তার (হেলাল আহমদের পরিবারের) উপকার হয়।
সলফ পূর্বপাড়ার বিশিষ্ট মুরব্বি আবদুল গফফার, মাঝপাড়া গ্রামের প্রবীণ মুরব্বি জহির মিয়া, পূর্বপাগা গ্রামের মুরব্বি গফুর আলী ও মধ্যবয়সী প্রতিবেশি লিলু মিয়া বলেন, ‘হেলাল আহমদ খুবই ভালো ছেলে ছিলো। খুবই সরল ছিলো। হঠাৎ তার মাথায় কী সমস্যা হলো কে জানে? দেখলে বুঝা যায় না, এমনিতে সে মানসিকভাবে অসুস্থ। তার ঘরের অবস্থা একেবারে খারাপ। বন্যায় ঘরটি ভেঙ্গে পড়েছে। একটা টিন, বাঁশ কিছুই ভালো নেই। সরকারের প্রতি দাবি, সরকারিভাবে যেনো ঘরটি তৈরি করে দেওয়া হয়।’
সলফ পশ্চিমপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মঞ্জুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, আমার জানামতে হেলাল আহমদ নেহায়েত গরিব ও সোজা-সরল একজন লোক। তিনজন কন্যা সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বড় বিপাকে আছেন তিনি। তার ঘরটি ভেঙ্গে পড়েছে। আর্থিক সংকটে ঘরটি তৈরি করতে পারছেন না। সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান, হেলাল আহমদের সাহায্যে এগিয়ে আসুন।
সলফ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক আরজু রবিন বলেন, প্রতিদিন এ রাস্তা দিয়ে আমার যাতায়াত। আমি দেখি একটি পরিবার কীভাবে দারিদ্র্যতার সাথে লড়া করে যাচ্ছে। পরিবারটি একেবারে অসহায়। ঘরদুয়ার ভেঙে পড়েছে। এখন সকলের সহযোগিতা পেলে ঘরটি পুনরায় নির্মাণ করতে পারবে। সরকারসহ সকলকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান করছি।
পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম রাইজুল ও ১নং ওয়ার্ডের সদস্য হিমেল খান রুকন বলেন, ‘হেলাল আহমদের বিষয়টি আমি জানি। সে অসহায় এটা সত্য। বন্যার পরে বা তারও আগে আমরা তাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। ইতোমধ্যে আমাদের হাতে তেমন কিছু নেই। আসলে তাকে দেবো। তার বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। মেম্বার হিমেল খান বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে সহযোগিতা করবো।’
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আমাদের কাছে আবেদন করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।’