তুরস্ক-সিরিয়ায় হু হু করে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) ভোরের দিকে আঘাত হানা রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী এ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এখনও অসংখ্য মানুষ ধসে যাওয়া হাজার হাজার ভবনের নিচে চাপা পড়ে থাকায় মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে কয়েক ঘণ্টা পরে আঘাত হানা ২য় ভূমিকম্পের ক্ষয়-ক্ষতির তথ্যও আসতে শুরু করেছে।

তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এএফএডি) প্রধান বলেছেন, ভূমিকম্পে প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে এক হাজার ১২১ জনে পৌঁছেছে।

এএফএডি মহাপরিচালক অরহান তাতার বলেন, ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত এক হাজার ১২১ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৭ হাজার ৬৩৪ জন। দেশজুড়ে ২ হাজার ৮৩৪টি ভবন ধসে গেছে।

অন্যদিকে, সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকার কর্তৃপক্ষ ও বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এলাকার উদ্ধারকারী গোষ্ঠী দ্য হোয়াইট হেলমেটের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, দেশটিতে ভূমিকম্পের আঘাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮০০ জনে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে, তুরস্কের দক্ষিণের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে ভূমিকম্পের প্রথম আঘাত হানার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর সেখান থেকে ৮০ মাইল দক্ষিণের কারামানমারাস প্রদেশে দ্বিতীয় ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। এই ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির তথ্য নতুন করে আসতে শুরু করেছে। যে কারণে প্রাণহানি ও ভবন ধসে যাওয়ার ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলে তুর্কি কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

যদিও দ্বিতীয় ভূমিকম্প আঘাত হানার আগেই কাহরামানমারাসে প্রথম ভূমিকম্পে অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে কর্তৃপক্ষ। মৃতের সংখ্যা অনেক বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সিরিয়ায় মৃত বেড়ে ৮০০

এএফপির পরিসংখ্যান বলছে, সোমবার ভোরের দিকের ভূমিকম্পের ফলে সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮৩ জনে দাঁড়িয়েছে। দেশটিতে ভূমিকম্পে যে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মৃতের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ায় তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কাঁদার লোকও নেই অনেক পরিবারে

একজন বৃদ্ধা কুর্দি ভাষায় কান্নাকাটি করছেন। তার ভগ্নিপতি, ভাতিজি ও ভাগ্নেরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন। তাদের জীবিত উদ্ধারের আশায় অপেক্ষার প্রহর গুনছেন তিনি। কিছু অল্পবয়সী প্রতিবেশী তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওই নারীকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা বলছেন, ‘কয়েক মিনিট আগে একজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তারা আপনার পরিবারকেও উদ্ধার করবে।’

তবে ওই নারীর পরিবার ১২ তলা ভবনের নিচতলায় বসবাস করতেন; যে কারণে তাদের জীবিত উদ্ধারের ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নন তিনি।

তিনি বলেন, ‘তারা নিচতলায় ছিল। ঘুমাচ্ছিল। আমি জানি না কেউ তাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে কি না… এখানে প্রচণ্ড ঠান্ডা। আমার বাচ্চাগুলো ধ্বংসস্তূপের নিচে জমে যাবে।’

তবে তুরস্কে এমন অসংখ্য পরিবারের খোঁজ পাওয়া গেছে, যাদের পরিবারের কোনো সদস্যেরই সন্ধান মিলছে না। এমনকি স্বজন হারানোর শোকে যে কান্না করবেন কিছু পরিবারে এমন একজনও জীবিত নেই।

উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে কারও কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে লোকজন চিৎকার করছেন
তুরস্কের একটি শহরের উদ্ধার তৎপরতার দৃশ্য তুলে ধরে বিবিসি লিখেছে, উদ্ধারযজ্ঞ চলার সময় আকস্মিকভাবে জনতা উচ্চস্বরে চিৎকার করছেন। তাদের হাততালি দিতেও দেখা যাচ্ছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে কারও কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে লোকজন চিৎকার করছেন।

তবে যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তার কোনো আত্মীয় নন এই হাততালি দেওয়া লোকজন। কেউ একজন যে উদ্ধার হচ্ছে, তাতেই তারা খুশি। সেখানকার পরিস্থিতি বর্ণনায় বিবিসি বলছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে নেমে আসে পিন-পতন নীরবতা। কারণ যাকে উদ্ধার করা হচ্ছে, তিনি মারা গেছেন।

বিবিসির তুরস্ক প্রতিনিধি হাতিস কামের দিয়ারবাকি থেকে বলেছেন, শহরটিতে হিমশীতল ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। আফটারশকের ভয়ে কোনো লোকজনই তাদের বাড়ির কাছাকাছি যেতে পারছেন না। যদিও তারা গভীর রাতে বাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে চলে গেছেন… শীত নিবারণের জন্য জ্যাকেট এবং জুতো নেওয়ার জন্য বাড়ি ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছেন তারা।

তুরস্কে প্রাণহানি ১০ হাজার ছাড়াতে পারে: ইউএসজিএস

ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে কেবল তুরস্কেই প্রাণহানির সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস। সংস্থাটি বলেছে, সোমবার ভোরে দক্ষিণ তুরস্কে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং এটি এক লাখে পৌঁছারও কিছুটা আশঙ্কা আছে।

ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতি ১০০ কোটি ডলার থেকে এক হাজার কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে; যা তুরস্কের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমান। ওই অঞ্চলের অতীতের ভূমিকম্প, সর্বাধিক কম্পনের আওতাধীন এলাকার জনসংখ্যার কাঠামো এবং সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত অঞ্চলের অবকাঠামোগত দুর্বলতার ওপর ভিত্তি করে এমন অনুমান করেছে ইউএসজিএস।

সংস্থাটি বলেছে, ভূমিকম্পে তুরস্কে প্রাণহানি এক হাজার থেকে ১০ হাজার জনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ৪৭ শতাংশ। আর ১০০ থেকে ১ হাজার জনে পৌঁছানোর সম্ভাবনা ২৭ শতাংশ। তবে ১০ হাজার থেকে এক লাখের মধ্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাও রয়েছে, সেটি ২০ শতাংশ।

ইউএসজিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রেকর্ড মাত্রার এই ভূমিকম্পে ব্যাপক হতাহত এবং ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এই ভূমিকম্পের বিপর্যয় প্রবল হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। ওই অঞ্চলের মানুষ এমন অবকাঠামো ব্যবস্থায় বসবাস করেন, যেগুলো ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। তবে কিছু ভূকম্পন প্রতিরোধী অবকাঠামোও রয়েছে সেখানে।

ভূমিকম্পের আর্থিক ক্ষতি ১০০ কোটি ডলার থেকে এক হাজার কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে; যা তুরস্কের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশের সমান।