সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ছানা মিয়ার ভাই কাচা মিয়া ও তাদের পরিরবারের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন এলাকাবাসী। যে কারও জমিতে এস্কেভেটর মেশিন লাগিয়ে ৮-১০ ফুট গর্ত খুঁড়ে মাটি ইটভাটায় নিয়ে যাচ্ছেন তারা। এমনকি চলাচলের রাস্তা কেটে ফেলা এবং গহীন গর্ত তৈরি করে অসহায় মানুষের ঘরবাড়ি ভাঙনের ঝুঁকিতে ফেলা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে এলাকাবাসী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবরে অভিযোগ দিয়েছেন। এতে সাক্ষর করেছেন মো. লাল মিয়া, দুদু মিয়া, মনজুর হোসেন, ফটিক মিয়া, আজির আলী, উছমান মেম্বার, কিবরিয়া, টেনু মিয়াসহ অনেকে। গত ১ মার্চ দেওয়া এই অভিযোগের অনুলিপি সিলেটের জেলা প্রশাসককেও দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি গ্রামবাসীর অভিযোগের সূত্র ধরে ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তারা জানান, ছানা মিয়া, কাচা মিয়া এবং ওলি তিন ভাই। গ্রামের পাশে ‘এসবিএফ’ নামে তাদের তিনটি ইটভাটা রয়েছে। ইটভাটায় মাটির প্রয়োজন হলে তারা অন্যের জমিতে এস্কেভেটর (মাটি কাটার যন্ত্র) লাগিয়ে গহীন গর্ত খুঁড়ে মাটি নিয়ে যান। এতে কারো অনুমতির তোয়াক্কা করেন না।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, কিছুদিন আগে খালপাড় গ্রামের হাওরে যাতায়াতের রাস্তাও কেটে দিয়েছেন কাচা মিয়া। ফলে গ্রামের লোকজন কৃষি কাজে কিংবা গরু-মহিষ চরাতে হাওরে যেতে পারছেন না। প্রতিবাদ করায় গ্রামের লোকজনকে নানাভাবে হয়রানিও করছেন তারা।
যদিও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাচা মিয়া।
তুরুকভাগ-খালপাড় গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, খালপাড় গ্রামের শেষভাগে মাঠে নামতেই একটি অংশে জমির মাটা কাটা। ক্ষেতের জমিতে খালের মতো অবস্থা। খালে নেমে তারপর জমিতে উঠতে হয়। বামদিকে কিছুটা সামনে দুই পাশে অন্তত ১০-১২ ফুট গভীর তিনটি গর্ত। দেখে বোঝা যাচ্ছে সম্প্রতি এগুলো কাটা হয়েছে। পাশে হাওরের বোরো ফসল দেখভাল করছিল দুই কিশোর। জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানায়, এস্কেভেটর মেশিন লাগিয়ে এই বড় গর্ত দুটি খুঁড়ে মাটি নিয়ে গেছেন কাচা মিয়া।
একটু দূরে গ্রামের লোকজন যে রাস্তা দিয়ে হাওরে যাতায়াত করেন সেই রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে চলাচল বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছেন কাচা মিয়া। কাটা রাস্তার পাশেই একটি এস্কেভেটর মেশিনও রাখা ছিল। সেখানে প্রায় এক বিঘা জায়গার মাটি কাটতে মেশিনটি রাখা হয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
গত কয়েক বছর ধরে দুই গ্রামের লোকজনের মালিকানাধীন বেশ কয়েক একর জায়গা থেকে এভাবে মাটি কেটে নিয়েছেন ছানা ও কাচা মিয়ারা।
ক্ষেতের মাঠ থেকে ফিরতে খালপাড় গ্রামের শেষভাগে মাজার ও মসজিদের সামনে দেখা হয় এক বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি ও এক যুবকের সঙ্গে। তারা প্রথমে এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাননি। পরে পরিচয় দিলে তারা বলেন, ছানা, কাচা ও ওলি তিন ভাইয়ের হাতে অনেকটা অসহায় এই দুই গ্রামের লোকজন। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে ধরে নিয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। স্থানীয় এক ব্যক্তিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগও রয়েছে তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে।
তারা আরও জানান, কাচা মিয়ারা কারো আধা বিঘা জমি কিনলে সেই জমিতে এস্কেভেটর লাগিয়ে আশপাশের আরও কয়েক বিঘা জমির মাটি কেটে নিয়ে যায়। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদের অন্যান্য জমিতেও মেশিন লাগিয়ে দেয়। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে খালপাড় ও তুরুকভাগ গ্রামের লোকজন কয়েকবার মুখোমুখি হয়েছেন। তাতেও কোনো লাভ হয় না। টাকার জোর থাকায় তারা যাচ্ছেতাই করছে। কাচা মিয়াদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পায় না।
খালপাড় বাজারে দেখা হয় সাবেক এক ইউপি সদস্যের সঙ্গে। তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলে তিনি প্রথমে মুখ খুলতে চাননি। তেমন কিছু জানেন না বলে জানান। পরে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, কাচা মিয়াদের বিরুদ্ধে কথা বলতে চায় না কেউ। কথা বললে তাদের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। তাদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে।
তুরুকভাগ গ্রামের নজরুল ইসলাম নামের এক যুবক সাহসের সঙ্গে সব বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কাচা মিয়া, সাবেক চেয়ারম্যান ছানা মিয়া ও তাদের ভাই ওলি এই এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি দুর্বল কাউকে পেলে ধরে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এতদিন সহ্য করলেও এখন দুই গ্রামবাসী প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।
গত সোমবার সন্ধ্যায় খালপাড় গ্রামে গেলে নদীর তীরে প্রায় ৩০ ফুট গভীর গর্ত খুড়ে মাটি ইটভাটায় নেওয়ার খবর পাওয়া যায়। পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ইটভাটার দুইশ মিটার দূরে এই জায়গাটির ঠিক পাশে কয়েকটি হতদরিদ্র পরিবারের বসবাস। ঘরবাড়ির সীমানাঘেষে গহীন গর্ত তৈরির কারণে বাড়িগুলো ভেঙে বিলীন হওয়ার উপক্রম। এরই মধ্যে একটি শৌচাগার ভেঙে পড়েছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকলেও বসবাসরত পরিবারগুলো প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।
জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে এত গভীর গর্ত খোড়া পরিবেশ আইনে অপরাধ হলেও কোনো নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না তারা। এ বিষয়ে জানতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
পরিদর্শনের সময় ঝুঁকিতে থাকা পরিবারের এক নারী এগিয়ে এসে এই প্রতিবেদককে তার ঘরের বর্তমান অবস্থা দেখার অনুরোধ করেন। এগিয়ে গেলে ওই নারীর স্বামী চান মিয়া জানান, ইটভাটার ধুলোর কারণে একদিকে তারা এ বাড়িতে শান্তিতে থাকতে পারছেন না, অন্যদিকে ঘরের ঠিক পাশে গহীন গর্ত খোড়ার কারণে তার ঘরটি ঝুঁকিতে পড়েছে। ইট-গাথুনির ঘরটিতে এরই মধ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারছেন না তিনিসহ আশপাশের পরিবারগুলো।
কেবল এই হতদরিদ্র পরিবার নয়, প্রতিষ্ঠিত অনেক পরিবারের জমিও বাদ যায়নি কাচা-ছানা গংদের কামড় থেকে। তুরুকভাগ গ্রামের উচ্চশিক্ষিত একটি পরিবার যাদের বেশিরভাগই গ্রামে বসবাস করেন না। এই সুযোগে সম্প্রতি তাদের কয়েক বিঘা জমিতে গর্ত করে মাটি নিয়ে যান কাচা মিয়া। টেলিফোনে এ পরিবারটি কাচা মিয়ার কাছে মাটি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি দোষ স্বীকার করে দ্রুত মাটি প্রতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ছয় মাসেও সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেননি।
খালপাড় ও তুরুকভাগ গ্রামবাসীর অভিযোগ পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেছেন গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনূর রশীদ চৌধুরী। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তিনি বলেন, গ্রামবাসীর অভিযোগ পেয়েছি। তবে কাচা মিয়া এসব জমি তার নিজের দাবি করেছেন। আমি গ্রামবাসীকে কাগজপত্র নিয়ে থানায় আসতে বলেছি।
তবে উপজেলা প্রশাসন থেকে এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এ বিষয়ে জানতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মৌসুমী মান্নানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিষয়টি তার স্মরণে নেই। কাগজ দেখে পরে বলতে পারবেন।
উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
কাচা মিয়াদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বাঘা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ। তিনি জানান, এদের বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। কয়েকবার তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা কোনোকিছুই মানছে না।
গত বৃহস্পতিবার উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে দুই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে জানান তিনি।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কাচা মিয়া। মুঠোফোনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একটি ভূমিখেকো চক্র আমার বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। রাতের অন্ধকারে আমার জমি থেকে মাটি কেটে নিয়েছে। এর প্রতিবাদ করায় তারা আমার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হয়ে উপজেলা প্রশাসন ও থানায় অভিযোগ দিয়েছে।
গ্রামের রাস্তার মাটি কেটে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি আমার ক্রয় করা জমি। এখানে তফশিলি কোনো রাস্তা নেই। মাটি কেটে ফিশারি করতে চেয়েছি। তখন খালপাড় ও তুরুকভাগের লোকজন এসে বলেছে এটি তাদের হাওরে নামার রাস্তা।
ইটভাটার পাশে নদী তীরবর্তী পুকুরমতো গহীন গর্ত খোড়ার অভিযোগটিও অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ তোলেন কাচা মিয়া। তিনি বলেন, রাতের অন্ধকারে কিছু লোক এই গর্ত খুঁড়ে মাটি নিয়ে গেছে।
গহীন এই গর্তের ঠিক পাশে বসবাস করা পরিবারগুলো তার জমিতে বসবাস করছে বলে দাবি করেন তিনি।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, কাচা মিয়ার জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ার সাহস আশপাশের কারো নেই। এই গ্রামে কারো এস্কেভেটর মেশিনও নেই। একমাত্র কাচা-ছানা মিয়াদের কাছে এই যন্ত্র রয়েছে।