সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও ইউনিয়নে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় নোয়াগাঁও হাইলা হাওর পাড়ে ১০০টি পরিবার নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হয়েছে। যা সিলেট জেলার মধ্যে সর্ববৃহৎ আশ্রয়ণ প্রকল্প। যেখানে ঠাই হবে অন্তত ৮০০ থেকে ১ হাজার মানুষের।
সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন ও নন্দীরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে নোয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্মাণ শ্রমিকদের উৎসাহী করার লক্ষে তাদের প্রত্যেককে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি একটি করে কম্বল দেয়া হয়।
সিলেট জেলা প্রেসক্লাব, সিলেট ইমজা, সিলেট প্রেসক্লাব ও গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় করেন গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তাহমিলুর রহমান।
এসময় গোয়াইনঘাটের ইউএনও জানান, প্রাকৃতিক সম্পদের গর্ভধারিণী ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা। এ উপজেলায় রয়েছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং, জল পাথরের বিছনাকান্দি, জলপ্রপাতের পান্তুমাই, মায়াবতী ঝর্ণা, মায়াবন, হিজল-করচের দামারী, জলাবন রাতারগুলসহ শতাধিক পর্যটন কেন্দ্র।
পুরো উপজেলা জুড়ে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর একটু পরপর সবুজ ছায়াঢাকা গ্রাম। গ্রামের বাড়িগুলোর মধ্যে অধিকাংশ বাড়ির দেয়াল ও চালা ঢেউটিনের। আধাপাঁকা দু-চারটি ঘরের সঙ্গে মাটির ঘরও চোখে পড়ে মাঝেমধ্যে।
এ উপজেলাধীন নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের এমনই এক গ্রামের নাম নোয়াগাঁও। যে গ্রামে বাস্তবায়িত হয়েছে নোয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্প। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে “বাংলাদেশের একজন মানুষও গৃহহীণ থাকবেনা” মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে দেশের সকল ভূমিহীণ ও গৃহহীণ অর্থাৎ ‘ক’ শ্রেণির পরিবার পুনর্বাসন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে গোয়াইনঘাট উপজেলায় ইতোমধ্যে ৮৯৫টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে। যার মধ্যে নোয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পে নির্মিত হয়েছে ১০০টি ঘর। এছাড়াও বর্তমানে এ উপজেলায় আরোও ২০৬টি ঘরের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
এক নজরে নোয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পঃ
মৌজা-লামাপাড়া, জে.এল নং- ১৬৬, খতিয়ান নং- ১, দাগ নং- ৪৭, ৪৯ ও ৫০ মোট জমির পরিমাণ ৫.৩৬ একর (দৈর্ঘ্য ৭৩০ ফুট, প্রস্থ ৩২০ ফুট), ভরাটকৃত জমির পরিমাণ ৩.২৫ একর (দৈর্ঘ্য ৬৩৫ ফুট, প্রস্থ ২২৫ ফুট) উক্ত জমির চতুর্পাশে খাল খনন পূর্বক জমি ভরাট করা হয়েছে। খননকৃত খালের দৈর্ঘ্য ১৪৫০ ফুট খালের পানিধারণ ক্ষমতা, ৪.৮৮ মিলিয়ন গ্যালন প্রকল্পে নির্মিত ঘরের সংখ্যা ১০০টি। যার প্রতিটি ঘরে দুটি বেডরুম, একটি বারান্দা, একটি রান্নাঘর ও একটি টয়লেট রয়েছে। এর প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় হয়েছে ২ লক্ষ ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা।
১০০ টি পরিবারের জন্য সাবমার্জেবল পাম্প ও ওভারহ্যাড ট্যাংকসহ ১০টি নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে পৃথক মিটারসহ বিদ্যুৎ সংযোগও প্রদান করা হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা :
সালুটিকর-গোয়াইনঘাট সড়কের নোয়াগাঁও থেকে প্রকল্পের সংযোগ সড়কের দূরত্ব ১ কিলোমিটার। যার পাকা করণের কাজ চলমান। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ও সালুটিকর বাজার থেকে এই প্রকল্পের দূরত্ব ৪ কিলোমিটার।
শিক্ষা ব্যবস্থা :
প্রকল্পের ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১টি কিন্ডার গার্টেন স্কুল ও ১টি স্কুল এন্ড কলেজ রয়েছে। এছাড়াও ৩ তলা বিশিষ্ট ১টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র এবং একাধিক মসজিদ ও মন্দির রয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলাধীন নন্দিরগাঁও ইউনিয়নের নোয়াগাঁও গ্রাম থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে ৫.৩৬ একর জমির চতুর্পাশে খাল খনন পূর্বক ৩.২৫ একর জমি ৬-৭ ফুট উচ্চতায় ভরাট করে প্রায় ২ বছর কম্পেকশন এর পর সেই জমিতে ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। ভরাটকৃত এ জমিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছে ১০০ টি ঘর। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীণ ১০০ টি পরিবারের প্রত্যেকে পাবেন ২ শতক জমিসহ ১টি ঘর।
এই ঘরের উপকারভোগীর নামের তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের কেউ কেউ এখনও অন্যের জায়গায় ঘর তুলে অস্থায়ী বসবাস করছেন। অনেকে আবার বসবাস করছেন সরকারের খাস জমিতে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোর মাধ্যমে এসব গৃহহীন ও ভুমিহীন পরিবারগুলো পাবে তাদের আপন ঠিকানা।
নিজের জায়গায় নিজের ঘরের সামনে দাঁড়ানোর নতুন স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে তাদের মনে। অসহায় এ মানুষগুলো তাদের নিজেদের স্থায়ী ঠিকানা হচ্ছে জেনে মহাখুশি। তারা এখন নিজদের আত্মপরিচয়ে মাথা উঁচু করে নতুন জীবনে যাত্রার স্বপ্ন দেখছেন।
উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের কাছাকাছি স্থানে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় প্রথম পর্যায়ে ৩টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছিলো। ২০২১ এর জানুয়ারি মাসে সেই ঘরগুলো পরিদর্শনে আসেন সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জনাব ইমরান আহমদ। পরিদর্শনের সময় কালবৈশাখী ঝড়ে বিধ্বস্ত একটি খড়ের ঘরের পাশে নোয়াগাওঁ গ্রামের ইউনুস আলী (৭০) নামের এক বৃদ্ধকে কান্নারত অবস্থায় মন্ত্রীর চোখে পড়ে।
এসময় মন্ত্রী তার সাথে কথা বলে তাকে শান্তনা দেন এবং তাকে একটি সরকারি ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে মন্ত্রী এলাকার খাস জমি সনাক্ত করে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি ঘর নির্মাণ করার নির্দেশ দেন। মন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে খাস জমি বাছাই পূর্বক মাটি ভরাটের কাজ শুরু করা হয় এবং পরবর্তীতে মাটি কম্পেকশন এর পর সেই জমিতে ঘর নির্মাণ করা হয়।
নোয়াগাঁও আশ্রয়ণ প্রকল্পটিকে মডেল গ্রাম বা সাস্টেইনেবল ভিলেজ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে এখানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা, পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থা, ডিপটিউবওয়েল, ওভার হ্যাড ওয়াটার রিজার্ভার নির্মাণপূর্বক ঘরে ঘরে পানি সাপ্লাই এর ব্যবস্থা সহ জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক সকল সুযোগ সুবিধা প্রদানের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
এই আশ্রয়ন প্রকল্পের ৩ পাশে খাল খনন করা হয়েছে যা এখানকার মানুষের পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি আবাদে সহায়তা করবে। এছাড়া প্রকল্পের পূর্ব পাশ দিয়ে একটি বড় খাল খননের পরিকল্পনা করা হচ্ছে যা সরাসরি পার্শ্ববর্তী নদীর সাথে সংযোগ থাকবে। খালের উৎস মুখে সোলার সেচ পাম্প বসানোরও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ‘গ্রাম হবে শহর’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প একটি ভাল উদাহরণ হওয়া সম্ভব বলে ইউএনও তাহমিলুর রহমান জানান।
মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন গোয়াইনঘাটের সহকারী কমিশনার (ভূমি) তানভীর হোসেন, গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে. এম. নজরুল ইসলাম, নন্দিরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস কামরুল হাসান আমিরুল, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা শীর্ষেন্দু পুরকায়স্থ, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শাহ দিদার আলম চৌধুরী নবেল, সিলেট ইমজার সভাপতি মাহবুবুর রহমান রিপন, সাধারণ সম্পাদক গোলজার আহমদ, সিলেট জেলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আল আজাদ, সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ইকরামুল কবির ইকু, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মকসুদ আহমদ, গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের সভাপতি এম এ মতিন, সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, সাবেক সভাপতি মনজুর আহমদ, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক মো, মিনহাজ উদ্দিন।
এছাড়াও সিলেট জেলা প্রেসক্লাব, সিলেট প্রেসক্লাব, সিলেট ইমজা ও গোয়াইনঘাট প্রেসক্লাবের দায়িত্বশীল ও নির্বাহী সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।