বিয়ানীবাজারে তিন খালে ‘অবৈধ ঘের’, দখলে প্রভাবশালীরা

‘জাল যার, জল তার’ -সরকারে এ নীতি অমান্য করে প্রভাবশালীরা সিলেটের বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী তিনটি সরকারি বহমান খালে বাঁশের বেড়া দিয়ে অবৈধ ঘের নির্মাণ করে মাছ শিকার করছে। ঘেরের আশপাশে স্থানীয় কোন জেলে কিংবা শৌখিন শিকারি মাছ ধরতে গেলে বাঁধার মুখে পড়ছেন, কেউ কেউ হচ্ছেন লাঞ্চিত।

আইনীভাবে নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও একশ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় একটি সরকারি বহমান খালের কিছু অংশ ইজারা নেয়ার নাম করে ইজারাদাররা তিনটি খালই দখল করে বাঁশের ঘের নির্মাণের পাশাপাশি নিষিদ্ধ নেটপাটা জাল দিয়ে প্রতিদিনই কয়েক লাখ টাকার মাছ শিকার করছে। অবৈধ পদ্ধতিতে মাছ শিকারের কারণে খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। এতে মাছের স্বাভাবিক বিস্তার যেমন বিনষ্ট হচ্ছে তেমনী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। একই সাথে পানি প্রবাহ বাঁধা সম্মুখিন হওয়ায় উজানে তৈরী হচ্ছে জলাবদ্ধতা, শংকার মধ্যে রয়েছে রোপা আমন আবাদকারি ‍কৃষকরা।

বিয়ানীবাজার উপজেলার তিলপাড়া ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাদেপাশা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ঝরাপাতা, জলুয়াখাড়া ও মুড়িয়া হাওর খালকে প্রভাবশালীর অবৈধ দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী ও এলাকাবাসী।

শুধু তাই নয়, এসব খালে বাঁশের ঘের তৈরি করে মাছ শিকার করায় খালের পানি স্বাভাবিক প্রবাহে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে। একইসাথে পার্শ্ববর্তী ফসলি জমির পানি নিষ্কাশনসহ নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয়দের। নদী আইন অনুযায়ী এসব প্রান্তিক জেলেদের জন্য উন্মুক্ত থাকার কথা। কিন্তু নদীগুলোতে অবৈধভাবে ৬/৭টি মাছের ঘের তৈরি করেছে প্রভাবশালীরা। ফলে জাল নিয়ে খালে নামতে পারছেন না মৎস্যজীবীরা। কখনো কখনো ইজারাদারের লোকেদের ধাওয়াও খেতে হচ্ছে সাধারণ মাছ শিকারিদের। এসব মৎস্য চাষীদেরও মাছ শিকারে বাঁধা দেয়ায় খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে সরকারি নির্দেশনা থাকলেও অদৃশ্য কারণে দখলদারদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে না।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঝরাপাতা, জলুয়াখাড়া ও মুড়িয়া খালের ছয়-সাতটি স্থানে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘের নির্মাণ করে পানি আটকে সুতিজাল দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। খালগুলোতে ত্রিবুঝ আকারে বাঁশ দিয়ে ঘের তৈরি করে নিষিদ্ধ বিভিন্ন ধরনের জাল দিয়ে পোনা মাছ, মা মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করছেন তার। খালে বাঁশের ভেড়া (ঘের) থাকায় নৌকা চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। একই সাথে খালে স্থানীয় অধিবাসী ও মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে আসলে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝরাপাতা, জলুয়াখাড়া ও মুড়িয়া হাওর খালের মধ্যে ঝরাপাতা খালটি জেলা পরিষদের খতিয়ানভুক্ত, তবে জলুয়াখাড়া ও মুড়িয়া হাওর খালটি ডিসি খতিয়ানভুক্ত। তিনটি খালের মধ্যে ঝরাপাতা খালটির কিছু অংশ মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে এক বছরের ইজারা নেন উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের মুজিবুর রহমান নামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। কিন্তু ওই ইজারাদার ঝরাপাতা খাল ইজারা নেয়ার নামে পার্শ্ববর্তী জলুয়াখাড়া খাল ও মুড়িয়া হাওর খালটিও অবৈধভাবে দখল করে বাঁশের ঘের নির্মাণ করেছেন। এতে ওই খালের আশেপাশের ফসলি জমির পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনেক কৃষকই জলাবদ্ধতার কারণে তাদের জমি চাষাবাদ করতে পারছেন না। বাঁধা দেয়া হচ্ছে সাধারণ মাছ শিকারিদেরও। এসব কারণে খালগুলো থেকে বাঁধ অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন তারা। এ বিষয়টি সমাধানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও প্রশাসনকে বারবার অবগত করার পরও অদৃশ্য কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

মনিম উদ্দিন, নাজিম উদ্দিন, কুতুব উদ্দিন, এবাদুর রহমান, নুরুল ইসলাম, রেহান উদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন স্থানীয় মৎস্য শিকারি অভিযোগ করেন, খালগুলোতে মাছ শিকার করতে গেলে ঘের মালিক ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা বাঁধা দেয়। কখনো কখনো তাদের ধাওয়াও খেতে হয়, একা কেউ মাছ শিকারে গেলে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হতে হয়। আমরা খালগুলোকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

তবে ইজারার নির্ধারিত স্থানেই মাছ শিকার করছেন জানালেও ইজারা নেয়ার প্রমাণাদি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে দেখাননি কেন জানতে চাইলে কোন সদুত্তর পাওয়া যায়নি অভিযুক্ত ইজারাদার মুজিবুর রহমানের কাছে।

তিনি বলেন, ‘আমি যতটুকু অংশ লিজ নিয়েছি সেই অংশে মাছ শিকার করছি। তবে বাঁশের ঘের নির্মাণ ও নেটপাটা স্থাপন বেআইনী এটা আমার জানা ছিল না।’

তিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে প্রতি বৎসর বর্ষা মৌসুমে বহমান নদীতে বাশের ঘের ও নিষিদ্ধ জাল দিয়ে স্থায়ীভাবে বাধ নির্মাণ করে অবৈধভাবে মাছ ধরা হয়। এতে করে এলাকার মৎস্য শিকারীরাসহ এলাকার গরিব মানুষের মাছ শিকারে অসুবিধা তৈরি হয়। বিভিন্ন এলাকার মাছ শিকারিরা লিখিত ও মৌখিক অভিযোগ জানালে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে বিষয়টি সমন্বয় সভার আলোচনায় উঠে আসে।

তিনি আরও বলেন, যদি ঘের মালিকদের কাছে ইজারা নেয়ার বৈধ কাগজপত্র থেকেও থাকে, তবুও একটি বহমান খালে এভাবে বাঁশের ঘের ও নিষিদ্ধ নেটপাটা ব্যবহার করা মৎস্য আইনে বেআইনী।

এদিকে, এলাকাবাসীর অভিযোগ পেয়ে গত ১৭ আগস্ট উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া আক্তার পরিদর্শনে যান। এ সময় তার সাথে তিলপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও বিয়ানীবাজার থানার পুলিশ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) তানিয়া আক্তার উপস্থিত ঘের নির্মাণকারিদের কাছে বৈধ কোন কাগজপত্র আছে কিনা জানতে চাইলে তারা জেলা পরিষদ থেকে খালগুলো ইজারা নেয়ার কথা জানালেও ইজারা নেয়া সংক্রান্ত কাগজ দেখাতে পারেনি। তিনি পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে ইজারা নেয়ার সংযুক্ত কাগজপত্র ও প্রমাণাদি দেখানোর নির্দেশ দিয়ে আসেন। এ দুইদিন অতিবাহিত হলেও ঘের মালিক কিংবা সংশ্লিষ্ট ইজারাদার সেটি উপজেলা কমিশনার (ভূমি) কাছে নিয়ে আসেন নি।

সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া আক্তার জানান, ‘স্থানীয়দের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা খালগুলো পরিদর্শন করে খালের উপর বাঁশের ঘের নির্মাণ ও নেটপাটা স্থাপন করার প্রমাণ পেয়েছি। এ সংক্রান্ত প্রমাণাদির কাগজপত্র পরবর্তী দুইদিনের মধ্যে দেখানোর নির্দেশ দেয়া হলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বিয়ানীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আশিক নূর বলেন, ‘আমরা এ রকম অভিযোগ পেয়ে খালগুলো ইজারা দেয়া হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখছি। ইজারা দেয়ার প্রমাণ না পাওয়া গেলে আমরা বাঁশের ঘের উচ্ছেদসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’