প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। শিক্ষা মন্ত্রণলায় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনও মানছে শিক্ষার্থীরা। পদত্যাগের দাবিতে অনড় শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের নাম ভাঙিয়ে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে।
উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দায় নিচ্ছে না কেউ। প্রশাসন থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা কমিটিও নিশ্চুপ। অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বল প্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানের মধ্যে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের চেষ্ঠাও চলছে। সবমিলিয়ে এক অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
বিশিষ্টজনরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মা-বাবা ও অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের আন্দোলন থেকে সরিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নিরব না থেকে দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকেই অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। প্রতিষ্ঠান প্রধানদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনে তাদের পদত্যাগ দাবি করছে শিক্ষার্থীরা।
এরই মধ্যে সিলেটের ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা দক্ষিন সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হয়েছে। কিশোরী মোহন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও আব্দুল গফুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রধান শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চলছে। একইভাবে সিলেট সরকারি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হয়। তবে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনের আলোকে তাকে আবার পূনর্বহাল করা হয়।
সিলেটের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সূত্র বলছে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেপথ্যে শিক্ষকদের অভ্যন্তরীন কোন্দল রয়েছে। শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে ইন্ধন দিচ্ছে। এতে করে পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হচ্ছে। তাছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আবেগের প্রভাবও পড়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন সিলেটের প্রধান সমন্বয়ক শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদুল্লাহ আল গালিব বলেন, সিলেটের সকল শিক্ষার্থীকে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধান বা শিক্ষককে আন্দোলন করে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করতে না করা হয়েছে। কোনো শিক্ষক অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকলে কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই মুহুর্তে যাতে কেউ কোনো আন্দোলনে না সেজন্য স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সঙ্গে যা করছেন সেটা কোনোভাবেই মানা যায় না। একজন শিক্ষক যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে তার বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করা হোক। বিধিমোতাবেক তাকে অপসারণ করা হবে। কিন্তু যেটা হচ্ছে সেটা দুঃখজনক।
তিনি বলেন, এই মুহুর্তে সবারই প্রাণে ভয় রয়েছে। শিক্ষা কর্মকর্তা-প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে ভয় পাচ্ছেঠ। কারণ পরে যদি শিক্ষার্থীরা তাদের পদত্যাগ দাবি করে। এখন বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এই অবস্থায় সমাধানের পথ দুইটি। একটি হলো-অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করে আন্দোলন থেকে দুরে রাখতে হবে। আর দ্বিতীয়ত হলো-প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটা মেনে নেওয়া।
এ বিষয়ে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহমিনা ইসলাম বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের ফলে আমাদের যা অর্জন হয়েছে তা অকল্পনীয়। কিন্তু এখন স্কুল-কলেজে যা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবে। দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ থাকলে প্রয়োজনে তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ঘাড়ে ধরে পদত্যাগ করাবে এটা কোনোভাবে কাম্য না। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অভিভাবকদের দ্রুত এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
সামগ্রিক বিষয়ে সিলেটের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) সুবর্ণা সরকার বলেন, খুব দ্রুতই প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মনোনয়নের কাজ শেষ হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে সমস্যা বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে সেসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিবেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আন্দোলন করে যেসকল শিক্ষককে পদত্যাগ করানো হয়েছে, সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তদন্ত করা হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শিক্ষকদেরকে অসম্মানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।