ভয়ংকর অনিয়মে জর্জরিত সিলেটের বিশ্বনাথের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। রোগীদের প্রত্যাশিত সেবা দেয়া দূরের কথা উল্টো রোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করার মতো কাজও হয় প্রকাশ্যে।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) সরেজমিনে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ঘুরে নানা অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার এসব চিত্র দেখা যায়।
হাসপাতালের প্রধান ফটকের ভেতরে প্রবেশ করলেই দুইপাশে চোখে পড়ে গরু-ছাগল চরানোর দৃশ্য। ভবনের সামনে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা নারী, পুরুষ ও শিশুদের লম্বা লাইন। তবে এসব উপেক্ষা করে টিকিট কাউন্টারের দায়িত্বে থাকা কেউ ব্যস্ত মোবাইলে, কেউ গল্প গুজবে। লাইনে দাঁড়ানো কেউ এর প্রতিবাদ করলে সার্ভার ডাউনের অযুহাতে তাদেরকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।
আবার টিকেটের হিসেবেও রয়েছে গরমিল। হাসপাতালের বহি:বিভাগে ডাক্তার দেখানোর টিকিট কাটলে পুরুষদের দেওয়া হয় ১০১ নম্বর কক্ষে আর মহিলাদের দেওয়া হয় ১০২ নম্বর কক্ষে। কিন্তু জনবল সংকট ও ডাক্তারদের অনুপস্থিতির অযুহাতে ১০২ নম্বর কক্ষটি বন্ধ রেখে পুরুষ-মহিলা উভয়কেই সেবা নিতে হয় ১০১ নম্বর কক্ষেই।
জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকের পরিবর্তে চিকিৎসাসেবা দেন ওয়ার্ড বয় সৌরভ। ইনজেকশন পুশ করা থেকে শুরু করে প্রাথমিক সবধরণের চিকিৎসাই দেন এই ‘বড় ডাক্তার’। আর সেখানে কর্মরত নার্স সামলান কম্পিউটার অপারেটরের কাজ। এর সাথে রয়েছে বিভিন্ন ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উৎপাত। ভবনের ভেতরেই রোগীদের ব্যবস্থাপত্রের ছবি, ভিডিও ধারণ করেন তারা।
তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যঅপার হচ্ছে সিসিটিভি ক্যামেরা, যা অবস্থিত নারীদের ইসিজি রুমের ঠিক ওপরে। নারীদের জন্য মহিলা নার্স দিয়ে পর্দার আড়ালে ইসিজি করা হলেও সচল রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরার কল্যাণে সবই দেখা যায় উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কক্ষের বড় মনিটরে।
হাসপাতালটিতে সেবা নিতে আসা বিভিন্ন রোগী ও তাদের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনিয়মের এখানেই শেষ নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রোগীর এক স্বজন বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে জানতে আপনাকে বেশি কষ্ট করতে হবে না। আপনি ওয়াশরুমগুলো একবার ঘুরে আসেন। বেসিন আর কমোডের অবস্থা একবার দেখেন। এইগুলা কি আমাদের পরিষ্কার করার কথা। আমরা এখানে এসে বিপদে আছি। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সংরক্ষিত একটি কেবিন আছে হাসপাতালে। আপনি গিয়ে দেখেন সেখানে যিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি কি মুক্তিযোদ্ধা? বা তার স্বজনের কেউ? তিনি অভিযোগ করেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রাইভেট রোগী হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও ভালো সেবা নিচ্ছেন কেবিনে ভর্তিরত ব্যক্তি।
সরেজমিনে মুক্তিযোদ্ধার জন্য সংরক্ষিত কেবিনে গিয়ে তার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। সেখানে ভর্তিরত রোগীর নাম আব্দুল বাছিত। বাড়ি পার্শ্ববর্তী ওসমানীনগর উপজেলায়।
আব্দুল বাছিতের স্বজন কামরুল হাসান এ প্রতিবেদককে বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা নই। আমরা ওসমানী হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। পরে এখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এখানে ভর্তি হই। তিনিই আমাদেরকে এই কেবিনে দিয়েছেন।
তবে এসব অনিয়ম, অবহেলা আর অভিযোগের ব্যাপারে বিশ্বনাথ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন (সুমন) এর সঙ্গে কথা বললে তিনি গতানুগতিক অজুহাতই দাঁড় করালেন। ‘জনবল সংকট’।
নারী পুরুষ একই কক্ষে চিকিৎসা দেয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, চিকিৎসকের সংকট থাকায় তাদেরকে একসঙ্গে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। অপরিচ্ছন্নতা-অব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গরু ছাগল চরানোর বিষয়েও একই বক্তব্য তার, জনবল সংকট।
নারীদের ইসিজি কক্ষে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যঅপারে তিনি বলেন, এটি শুধু আমি মনিটরিং করি। আমি ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পারেন না। এতে সেবা প্রত্যাশী নারীদের গোপনীয়তা লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।