মুসলমানদের বড় দুই উৎসবের একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আজহা। প্রত্যেক ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ে কিছু আনন্দোৎসব থাকে। মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তপ্রাপ্তি তথা ইসলাম প্রচারের প্রথম দিকে ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদ আসেনি। অর্থাৎ মক্কি জীবনে ঈদ উদযাপন ছিল না। মহানবী (সা.)-এর মদিনায় হিজরতের পরের বছর অর্থাৎ ৬২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ঈদ উদযাপিত হয়ে আসছে। সেই থেকে অদ্যাবধি মুসলিম বিশ্বে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়ে আসছে। ঈদ মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব বা অবশ্য পালনীয়। শুরুর দিকে ঈদ উদযাপনে আজকের মতো এত রীতিনীতি ও আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সামাজিক বিবর্তন ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়নে কালক্রমে বিভিন্ন দেশ ও সমাজে স্থানীয় কিছু আনন্দ সংস্কৃতি ঈদে যুক্ত হতে থাকে। ফলে ঈদ উদযাপনে দেশ ও অঞ্চলভেদে কিছুটা বৈচিত্র্যও দেখা যায়। তবে মূল নির্দেশনা হলো ঈদের নামাজ আদায়, নতুন কাপড় পরা, সুগন্ধি মাখা, মিষ্টান্ন খাওয়া, অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো প্রভৃতি।
আমাদের দেশে মোগলদের আগমনের পর ঢাকায় ঈদ উৎসব শুরু হয়। ধানমন্ডি ঈদগাহও নির্মাণ করেন মোগলরা। প্রত্যন্ত এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ঈদ আনন্দ উৎসব পালন তখনও দেখা যায়নি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ঢাকাকেন্দ্রিক ঈদ উদযাপন সারা দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। সেই সময় দেশে এত মসজিদ-ঈদগাহও ছিল না। বেশি দূর যেতে হবে না। ১৯৮০-এর দশকে বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনের চিত্র দেখেই অনুধাবন করা যায়, বিগত ৪ দশকে ঈদ পালনে কতটা জৌলুস যোগ হয়েছে। আজ থেকে ২০-৩০ বছর আগেও ঈদের নতুন কাপড় শুধু সামর্থ্যবানরাই ক্রয় করতে পারতেন। বেশির ভাগ মানুষকে লুঙ্গি, গেঞ্জি ও শার্ট ক্রয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। স্যাটেলাইট টিভির যুগের আগে ঈদের অনুষ্ঠান মানেই বিটিভির আনন্দ মেলা, একটি পুরোনো বাংলা সিনেমা ও বড়জোর একটি ঈদের নাটক। আর ৮টার সংবাদে রাজধানী ও বিভাগীয় শহরগুলোর ঈদ পালনের সংবাদ। বঙ্গভবন ও গণভবনে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লাইন ধরে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের সচিত্র সংবাদ বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে মানুষ উপভোগ করতেন। ঈদের দু-এক দিন আগে ঈদের কেনাকাটা শুরু হতো। কয়েক ধরনের পিঠা ও সেমাই ছিল ঈদ খাবারের মূল মেন্যু। অথচ এখন বাংলাদেশে রমজানের শুরু থেকেই ঈদের পোশাক ও অন্যান্য পণ্য কেনা শুরু হয়ে যায়। ঈদের দিন খাবার পরিবেশনেও আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের চিত্র ফুটে ওঠে। সামর্থ্যবানরা ঈদ উপলক্ষে খাদ্যসামগ্রী ও নতুন পোশাক তুলে দিচ্ছেন অসহায়দের মাঝে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয় ঈদকে ঘিরে। ঈদের শপিং দেখলে মনে হবে না এ দেশে কোনো অর্থনৈতিক সংকট আছে। এটা ঠিক, বাংলাদেশে ধনী-গরিব ব্যবধান বেড়েছে।
মূল্যস্ফীতিতে অনেকের জীবন ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে এও মানতে হবে, বিগত দুই দশকে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, জীবনযাত্রার মানে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। টানা তিন বছর কোভিড সংকট, গেল বছর দেশে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ বয়ে গেলেও বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনে অবস্থাদৃষ্টে আর্থিক টানের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের অন্যতম পোশাক বিপণি মার্কেট বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেট ছাই হয়ে গেলেও সারা দেশে এবারের ঈদে দুই লাখ কোটি টাকার মতো কেনাকাটা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যদিও মুদ্রাস্ফীতি নিম্ন আয়ের মানুষকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলেছে। তাদের ঈদ আনন্দে ছন্দঃপতন ঘটেছে। এবার বিদ্যুৎসংকট ঈদ উপভোগে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে এ আশংকা অনেকের। কয়েক বছর আগেও ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে নানা দুর্ভোগ ছিল। দৃষ্টান্তযোগ্য পদ্মাসহ বেশ কিছু সেতু নির্মাণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে এ দুর্ভোগ অনেকটা লাগব হলেও এবারের ঈদ আনন্দে বাগড়া বসিয়েছে বিদ্যুৎসংকট।
আওয়ামী লীগের টানা তিন মেয়াদের অন্যতম সাফল্য বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন। কিন্তু সাম্প্রতিককালে বিদ্যুতের নাজুক হাল সরকারকে সমালোচনায় ফেলেছে, যা ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। যদিও প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হচ্ছে। কিন্তু মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। এটি কি সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটি নাকি সরকারকে বেকায়দায় ফেলার ষড়যন্ত্র, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আবার জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত তাপমাত্রার রেকর্ড বৃদ্ধি সারা দেশে অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। তার পরও দেশে বয়ে যাওয়া দাবদাহকে উপেক্ষা করে মানুষ ছুটছে নাড়ির টানে প্রিয়জনদের কাছে প্রিয়, জন্মভিটায়।
পাশাপাশি এবারের ঈদ উদযাপিত হচ্ছে বোরো ধান ঘরে তোলার ভরা মৌসুমে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঝড় ও শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছে। সরকার থেকে বলা হয়েছে শিগগিরই বোরো ধান কাটা সম্পন্ন করতে। ফলে হাওর এলাকা স্বাভাবিকভাবেই বোরো ফসল কাটায় ব্যস্ত। বোরো ধানের ফলনও হয়েছে ভালো। আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এ ফসল ঘরে তোলাই হচ্ছে কৃষিভিত্তিক বাংলার গ্রামাঞ্চলের ঈদ আনন্দ।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাতে ঈদের তিন মাহাত্ম্য উঠে এসেছে। তা হলো আনন্দ, সাম্য ও আত্মার পরিশুদ্ধি। কিন্তু বাস্তবে ঈদের অন্যতম দুটি মাহাত্ম্য, সাম্য ও আত্মার পরিশুদ্ধি আমাদের ঈদ উদযাপনে অনুপস্থিতই বলা চলে। যদিও আনন্দ উপভোগের সঙ্গে সমাজ থেকে মানুষে মানুষে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবধান দূর করা ও আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটিয়ে সহজ-সরল জীবনযাপন হলো ঈদের প্রকৃত বার্তা। সাম্যের আলো ছড়িয়ে পড়ুক। আর এর বাস্তবায়ন হলে একবিংশ শতাব্দীর উন্নয়নের মূল চ্যালেঞ্জ জন-নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের সংশয় থাকত না।
লেখক : অধ্যাপক ও উপাচার্য, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট