শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বিরোধী আন্দোলনের পর অপ্রত্যাশীতভাবে চির ধরেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে। তবে আন্দোলনের এক বছর পর হয়ে গেলেও এখনো সেই সম্পর্কে জোড়া লাগেনি। শিক্ষার্থীদের দাবী পূরণের বিপরীতে ক্লাসরুম, পরীক্ষার খাতায় ও ভাইবা বোর্ডে নানা ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে আন্দোলনকারীদের।
অন্যদিকে শিক্ষকদেরকেও নানা উস্কানি ও কটুক্তিমূলক কথা বলে শিক্ষার্থীরাও হেনস্থা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে শিক্ষকদের। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় প্রশাসনের আয়োজনে জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মী ব্যতিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা উপস্থিত থাকে না বলে দেখা গেছে। আবার শিক্ষার্থীদের অনুষ্ঠানেও উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় নি।
এছাড়া আন্দোলনের পর শিক্ষকদের মাঝে অন্তর্কোন্দল ও বিভক্তি বেড়েছে। আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের দুটি ও বিএনপি-জামায়াত পন্থী শিক্ষকদের দুটিসহ মোট চার গ্রুপে বিভিক্ত হয়ে পড়েছে শিক্ষকরা। আর এর প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় পড়েছে বলে মনে করছেন সিনিয়র শিক্ষকরা।
অন্যদিকে উপাচার্য অপসারণের বিষয়ে সরকারের উচ্চ মহল থেকে আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও এখনো রাষ্ট্রপতি কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে কোন সিদ্ধান্ত জানানো হয় নি। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা এখানো প্রত্যাহার হয় নি।
আন্দোলনের পর যেমন আছে শাবি
শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিকের চেষ্টা
ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিভাগগুলোতে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ নানা পদক্ষেপের মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এমনকি নানা ধরণের প্রতিযোগিতামূলক খেলাধুলা, শিক্ষার্থীদের চাহিদা মোতাবেক আধুনিক টং নির্মাণ, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম, বিভাগগুলোতে নবীনবরণ ও কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়ামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি, ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য্য বর্ধনে নানা পদক্ষেপ ও মুজতবা আলী হল উদ্বোধনসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
তবে এর বাইরে আন্দোলনের পর অনেক কিছুতে কোন দৃষ্টিপাত ছিলো না সরকার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। অনেক কিছুর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির সমীকরণে আন্দোলন পরবর্তী বছর খুব বেশি স্বাভাবিক হয় নি। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের বহুমুখী বিপরীত সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বাভাবিক পরিবেশ অনেকটাই অস্বাভাবিক রয়ে গেছে।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে ভাঙ্গন
আন্দোলনের সময় থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্কে চির ধরেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। তথাকথিত উপাচার্যপন্থী শিক্ষক নানাভাবে শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসরুমে হেনস্থা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ক্লাসে আন্দোলনকে উদ্দেশ্য করে নানাবিধ আলাপচারিতা, আন্দোলনে ব্যর্থতায় হেয় করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইঙ্গিতমূলক কথা বলা, আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের অহেতুক প্রশ্ন করা ও উত্তর না পারলে অপমান করা, পরীক্ষা নম্বর কমে যায়, মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে কোন ধরণের ছাড় না দেওয়া ইত্যাদি। এর বিপরীত চিত্র রয়েছে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে। ক্লাসরুমে অযথা কথা বলা, ক্যাম্পাসে হেয় করতে কটুক্তি ও উত্তেজনাকর কথাবার্তা বলে শিক্ষকদেরকেও নানাভাবে উস্কানি ও অপমান করা হয় বলে শিক্ষকদের অভিযোগ রয়েছে।
পুলিশের অজ্ঞাত মামলা তোলা হয় নি
গত বছরের ১৬ জানুয়ারি আইআইসিটি ভবনের সামনে পুলিশি হামলার ঘটনায় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে জালালাবাদ থানা পুলিশ। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে এ মামলা নিষ্পত্তির দাবি থাকলেও এখনো পর্যন্ত এ মামলা নিষ্পত্তি হয় নি বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এমনকি অজ্ঞাত আসামীদের তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি বলে এ মামলার অগ্রগতি হয় নি বলে পুলিশ সুত্রে জানা গেছে বলেও জানিয়েছেন তারা। এ বিষয়ে সিলেটের জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজমুল হুদা খান বলেন, মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয় নি। তবে বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসন কাজ করছে।
বছর জুড়ে আলোচনায় ছিলো স্প্লীন্টারবিদ্ধ সজলকুন্ডু
সেদিনের ঘটনায় পুলিশের ছোড়া শটগানের গুলিতে মারাত্মক ৮৩টি স্প্লীন্টারবিদ্ধ হয় নৃবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও আইআইসিটি ক্যাফেটেরিয়ার তৎকালীন পরিচালক সজল কুন্ডু। অস্ত্রপাচারে তার শরীর থেকে ৮টি স্প্লীন্টার বের করা হলেও ৭৫টির বেশি স্প্লিন্টার নিয়ে যন্ত্রণাকাতর জীবন কাটাচ্ছে সে। এমনকি তার একমাত্র উপার্জনের কেন্দ্রবিন্দু ক্যাফেটেরিয়াও আর ফিরে পায় নি সে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে একক অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এছাড়া সরকার থেকে সকল চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের কথা থাকলেও এখন কিছুই পাচ্ছে না । তাছাড়া তাকে চাকরি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয় নি। এ বিষয়ে সজল বলেন, আন্দোলনের পূর্বে ক্যাফেটেরিয়া পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। আন্দোলনে আমি আহত হয়েছি। আন্দোলনের একটা দাবি ছিল আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা ও আমার ক্ষতিপূরনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু এসবের কোনোকিছু করা হয় নি বরং নিয়ম দেখিয়ে আমার কাছ থেকে ক্যাফেটেরিয়া কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ক্যাফেটেরিয়া নিয়ে আমাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে।
এক বছরেও হয় নি তদন্ত রিপোর্ট
১৬ জানুয়ারি পুলিশের হামলার ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিবেদন দিতে জমা দিতে পারিনি। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান গণিত বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ঘটনার তদন্তে আলামত বা প্রমাণের জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থী, প্রতক্ষদর্শীদের কাছ থেকে আমরা তেমন কোন সাড়া পায়নি। ফলে তদন্তের অগ্রগতি স্থবির হয়ে গেছে। আমরা তদন্ত কমিটির মেম্বারদের নিয়ে ৪/৫ বার মিটিং করেছি। এছাড়া, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও দুইজন ডিন পরিবর্তন হয়ে যাওয়াই তদন্ত কমিটি কাজ ব্যহত হয়েছে, এজন্য তদন্ত প্রতিবেদন এখনো জমা দেওয়া সম্ভব হয় নি।
আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি রাখে নি কেউ, রাষ্ট্রপতি থেকে মিলেনি সাড়া
গত বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫টি দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। এর মধ্যে শুধুমাত্র সাবেক শিক্ষার্থীদের উপর দায়েরকৃত মামলা প্রত্যাহার হলেও অন্য কোন দাবি তেমন পূরণ হয় নি। এছাড়া উপাচার্য অপসারণের দাবির বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রীর এখতিয়ারের বাইরে উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ হবে এবং পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
এমন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও শিক্ষার্থীদের সাথে মুঠোফোনে কথা বলেন এবং বিষয়টি সমাধানে রাষ্ট্রপতির সাথে তিনিও কথা বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। এমনকি পুলিশী হামলার বিষয় উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি ও আচার্য আব্দুল হামিদের কাছে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি এবং নতুন যোগ্য উপাচার্য নিয়োগের দাবি জানিয়ে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। এমনকি সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল দম্পতি ক্যাম্পাসে এসে ‘শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে সরকারের উচ্চ মহলের প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন’ বলে আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনশন ভাঙিয়েছিলেন। সরকারের উচ্চ মহলের এতসব ব্যক্তিদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো তার কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানানো হয় নি বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
আন্দোলনকারীদের পরিকল্পিতভাবে হেনস্থার অভিযোগ
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষক ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনকারীদের হেনস্তার অভিযোগ তুলেছিল শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, ১৬ জানুয়ারি পুলিশি হামলার পর যেসব শিক্ষার্থী আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে। স্প্লীন্টারবিদ্ধ সজলের কাছ থেকে পরিকল্পিতভাবে আইআইসিটি ক্যাফেটিরিয়া ছিনিয়ে নেওয়া, নিয়মিতই ক্লাসে শিক্ষক কতৃক কটু কথা ও টিজের শিকার, ক্লাসে অহেতুক প্রশ্ন করে করা, থিসিসে শিক্ষক না পাওয়া, পরীক্ষায় অহেতুক নকল সার্চ করা, একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় উঠিয়ে দেওয়া, নকল করে ধরা পড়ায় পরিকল্পিতভাবে দ্রুত সময়র মধ্যে শাস্তি নিশ্চিতকরণ, হল থেকে পরিকল্পিতভাবে আন্দোলনকারী শিক্ষাথীদের বের করা ইত্যাদি। সে সময় শিক্ষার্থীরা জানিয়েছিলেন, আন্দোলনের পর থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বৈপরীত্য ও দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
দুই মেরুকরণে শিক্ষার্থী-প্রশাসন
উপাচার্য বিরোধী আন্দোলনের পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনের সদস্যরা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে সংগীত ও বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতেন। কিন্তু আন্দোলন পরবর্তীতে অধিকাংশ সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃপক্ষের আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানে তেমন উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় নি। এ বিষয়ে সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতারা জানান, যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি শিক্ষার্থীদেরকে পুলিশ দিয়ে এনে ক্যাম্পাসে লাঠিপেঠা ও পুলিশ নিয়ে হামলা করতে পারে, তার অনুষ্ঠানের অংশগ্রহণ করি কিভাবে?। এভাবে দূরত্ব বাড়াতে অধিকাংশ সংগঠন অংশ নেন না ওই সকল অনুষ্ঠানে। তবে নিজেদের প্রোগ্রাম, বিভাগীয় অনুষ্ঠানে কিংবা অন্যকোনো কর্তৃপক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে থাকেন বলে সাংস্কৃতিক নেতাকর্মীরা।
শিক্ষকদের মধ্যেও বিভক্তি ও নতুন শিক্ষক সংগঠন
আন্দোলনের কারণে ও উপাচার্যকে আন্দোলনের সময় সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক দলমত নির্বিশেষে উপাচার্যের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছে। আবার কিছু শিক্ষক আন্দোলনের সময়ে উপাচার্যের সাথে না থাকায় তারা উপাচার্যসহ অনেকের চক্ষুশুল হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আন্দোলনের পর ক্যাম্পাসে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সহযোগিতায় না থাকায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের একাংশে সাথে আতাত করে শিক্ষক সমিতিতে উপাচার্যপন্থী প্যানেল ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তচিন্তা চর্চায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ প্যানেলকে নেতৃত্বে নিয়ে আসে। বিষয়টি এ প্যানেলের শিক্ষকদের একাংশের কাছে স্পষ্ট হলে জাতীয়তাবাদে শ্রদ্ধাশীল শিক্ষকরা বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষক প্যানেল থেকে বের হয়ে ‘জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম’ নামে নতুন সংগঠন গঠন করেছে।
এ বিষয়ে আন্দোলনের মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ বলেন,“অনশন ভাঙ্গার পর ২৭ জানুয়ারি আমরা জাফর স্যারের সিলেটের বাসায় বসি। সেখানে ইয়াসমিন ম্যাম ছিলেন, একটি গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। সেখানে আমরা কয়েকজন ভিসিকে কিভাবে সরানো হবে এ বিষয়ে খুঁটিনাটি সবকিছু জিজ্ঞাসা করছিলাম। তখন আমাদের সামনে বসেই জাফর স্যার শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ফোনে কথা বলেন। শিক্ষামন্ত্রী তখন এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিলেন না। তখন গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা স্যারের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে বলেন, “তাকে (ভিসিকে) কী প্রক্রিয়ায় সরানো হবে সে ব্যাপারে আমাদের আলোচনা হয়েছে।” তখন তিনি ( গোয়েন্দা কর্মকর্তা) গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে সরানোর উদাহরণ দেন এবং আমাদের এভাবে বোঝান যে, বিষয়টাকে একটা উইন উইন সিচুয়েশনে রাখতে হবে সরকারের জন্য। সরকার চায় না এখনই ভিসিকে সরাতে। উনি বললেন, “আমরা বুঝতে পেরেছি যে তোমাদের আন্দোলন যৌক্তিক। সেহেতু একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাকে (ভিসিকে) আমরা সরাবো। ৩-৪ মাস লাগবে।” এছাড়া রাজ জানান, “শিক্ষার্থীরা যেন ভিসির পদত্যাগের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠে, সেজন্য ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা শিক্ষামন্ত্রীকে সংবাদ সম্মেলনে সেভাবে কথা বলার পরামর্শ দেন। এরপর থেকে প্রতিনিয়ত ‘পরের মাসে হয়ে যাবে, তার পরের মাসে হয়ে যাবে’ আশ্বস্থ করা হলেও এখন পর্যন্ত তাঁকে (ভিসি) সরানো হয়নি।”
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের হয়রানির ও হেনস্থার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক আমিনা পারভীনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “কোনো ছাত্র এরকম কোনো বিষয় আমাকে অবগত করেনি, তাই এ বিষয়ে আমার মন্তব্য করার কিছু নেই। আন্দোলনের পর প্রথম দিকে কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল। কিন্তু এখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিক আছে।”
আন্দোলনের সুত্রপাত ও যা ঘটেছিলো ১৬ জানুয়ারি ঘিরে
১১ জানুয়ারি রাতে বেগম সিরাজুন্নেসা হলের তৎকালীন প্রভোস্ট জাফরিন আহমেদ লিজার অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে হলের ছাত্রীরা। উপাচার্য আশ্বাস দিলেও যথাযথ সমাধান না পেয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে শিক্ষার্থীরা। এমনকি শিক্ষার্থীদের একটি দল উপাচার্যের সাথেও সাক্ষাত করে। তাতেও যথাযথ সমাধান না আসায় আন্দোলন চলমান থাকে। এমনকি আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের মদদে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদেরকে বাঁধা দিতে থাকে এবং একপর্যায়ে মারধর করে।
পরে ১৬ জানুয়ারি শিক্ষক প্রতিনিধিদের সাথে উপাচার্য আলোচনা সেরে বের হলে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের মুখোমুখি হতে চান। এসময় শিক্ষার্থীদেরকে দেখে প্রশাসনের কিছু শিক্ষকের মদদে উপাচার্য আশ্রয় নেন আইআইসিটি ভবনে। ৩ ঘন্টার বেশি সময় উপাচার্য অবরুদ্ধ থাকেন সেখানে। পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় সেখানে পুলিশের ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (সিআরটি) সেখানে উপস্থিত হয় । পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, শিক্ষার্থীরা পুলিশের উপর ইট পাটকেল ছোড়া শুরু করলে প্রথমে লাটিচার্জ এবং পরে রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ডগ্রেনেড ছুড়তে থাকে। এতে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ ৭০ জনের অধিক শিক্ষার্থী এ হামলার শিকার হন। ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসন।
এদিন রাত থেকেই প্রভোস্ট বিরোধী আন্দোলন রূপ নেয় উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনে। শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে তার নিজ বাসভবনে অবরুদ্ধ করে অবস্থান কর্মসূচি পালন করতে থাকে। এমনকি এক পর্যায়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ, সমাবেশ, উপাচার্য পদত্যাগের আল্টিমেটাম, শিক্ষার্থীদের অনশন, মশাঁল মিছিল, প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝুলানো, কাফনের কাপড় ও প্রতীকী লাশ নিয়ে মৌন মিছিল, বাসভবনে সর্বসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় মানবদেয়াল, উপাচার্যের বাসভবনের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, উপাচার্যের নামে নানা ব্যঙ্গাত্মক দেয়ালিকা ও গ্রাফিতি অঙ্কনসহ টানা ১০ দিন বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
২৪ জানুয়ারি অনশনস্থলে ড. জাফর ইকবাল দম্পতি উপস্থিত হন। আশ্বাস দেন তারা যে, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তারা এসেছেন এবং তাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষার্থীরা অনশন ভাঙেন তাদের হাতে। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে শিক্ষার্থীদের সকল দাবি মেনে নেওয়া ও উপাচার্য অপসারণের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে আশ্বাস দেওয়ার প্রায় এক বছর পার হয়ে গেলেও সেসব কোন কিছুই দৃশ্যমান হয় নি।