বন্যার পানি থেকে ধানসহ ফসলরক্ষা করার জন্য বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু বাঁধের উচ্চতা কচি ধানগাছের উচ্চতা থেকেও কম করা হয়েছে। উচ্চতা ৬-১০ মিটার করার কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে ২-৪ মিটার! চার বছরের কাজ শেষ করতে লেগেছে আট বছর। এই সময়ের মধ্যে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ১৩ জন দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তারপরও সুচারুরূপে কাজ সম্পন্ন হয়নি। অসংখ্য গলদ ধরা পড়ছে। ‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, যথাযথ যাচাই-বাছাই না করেই এ প্রকল্পের বিভিন্ন কাজ বা অঙ্গগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে প্রয়োজনীয় স্থানে দরকারি অঙ্গটি নির্মিত হয়নি। প্রকল্পটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সময় টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে কোনো এক্সিট প্লান করা হয়নি। তাইতো প্রকল্পটি তিন বার সংশোধন করেও ৪০ শতাংশ বিভিন্ন অঙ্গের কাজ উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী হয়নি। অর্থাৎ যেসব স্থানে হওয়ায় কথা ছিল ২০টির মধ্যে আটটিতে তা বাস্তবায়িত হয়নি।
যেমন, সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে একটি রেগুলেটর নির্মাণের কথা থাকলেও তা চাতল হাওরে হয়েছে। এ কাজে অনেক বছর লাগায় বাঁধগুলোর অধিকাংশ নষ্ট ও বিলীন হয়ে গেছে। একইভাবে সিলেটে নির্ধারিত ১৪টি ড্রেনেজ আউটলেটের মধ্যে ১২টি-ই হয়নি। ২২টি ইরিগেশন ইনলেটের মধ্যে ৭টির কাজ হয়নি।
এটি হচ্ছে হাওরের মানুষকে রক্ষা করার তথা জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পটির বাস্তব চিত্র। এটি উঠে এসেছে প্রভাব মূল্যায়ন খসড়া প্রতিবেদনে। সাধারণত কোনো প্রকল্প শেষ হলে তা কতোটুকু কার্যকর হয়েছে তা জানতেই সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলো নিয়ে ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’ (আইএমইডি) এই প্রতিবেদন করে থাকে।
‘হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক ফজলুর রশিদের সঙ্গে সোমবার ও মঙ্গলবার একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন না ধরায় তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত মহাপরিচালক ড. জিয়া উদ্দিন বেগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত না। কিছু জানতে হলে পিডির সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারা বলতে পারবে।’
কিন্তু এ প্রকল্পের পিডি তো ১৩ জন ছিলেন। কার সঙ্গে কথা বলব? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মিটিংয়ে আছি। যাকে দরকার মনে করেন তার সঙ্গে কথা বলেন।’
আইএমইডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, চার বছরের জায়গায় প্রকল্পটি আট বছরে শেষ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ছয় বছরে মাত্র ২৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর শেষ দুই বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ শতাংশ। এ কাজ করতে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যে ১৩ জন দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে কেউ পূর্ণকালীন ছিলেন না। অতিরিক্ত দায়িত্বপালন করেছেন। ফলে ঠিকমতো তদারকি হয়নি বাঁধের কাজ। এর মধ্যে মাত্র ১৪ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসমাইল হোসেন। সর্বশেষে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. নিজামুল হক ভূইয়া প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন আট মাস।
প্রকল্পের প্রধান প্রধান কাজ ছিল এক হাজার ৬৭৪ কিলোমিটার ডুবন্ত বাঁধ আগের অবস্থায় আনা, ২৭ কিলোমিটার কম্পার্টমেন্টাল ডাইক নির্মাণ, ১১টি পানি নিষ্কাশন অবকাঠামো (রেগুলেটর) নির্মাণ, ১৪টি ড্রেনেজ আউটলেট নির্মাণ, ১৩টি কজওয়ে, ২২টি ইরিগেশন ইনলেট ও ১১১টি পুরাতন রেগুলেটর পুনর্বাসন। এ ছাড়া ১৪৬ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ খাল পুন:খনন, ১১৬ কিলোমিটার সুরমা বৌলাই রিভার সিস্টেম ড্রেজিং ও ৪৮ হেক্টর (৩৬০ বিঘা) জমি অধিগ্রহণ।
এ সব কাজের জন্য পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট বাবদ ৬৭ লাখ টাকা। ভ্রমণভাতা হিসেবে প্রকল্প পরিচালকরা নিয়েছেন ৬৭ লাখ টাকা। ১৫টি হাওড়ের এসআইএ স্টাডিতে ৬৯ লাখ, বাঁধ জরিপে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় ৫ কোটি টাকা, রিভার ড্রেজিংয়ের জরিপে এক কোটি টাকার বেশি ব্যয় করা হয়েছে।
বাঁধের উচ্চতা ৬-১০ মিটার করার কথা থাকলেও বাস্তবে হয়েছে ২-৪ মিটার। অর্থাৎ বাঁধের উচ্চতা তুলনামূলকভাবে অনেক কম হয়েছে। কোথাও বাঁধ এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে যা ঘাসের আবরণে ঢেকে যায়। বাজিতপুরের একটি ডুবন্ত বাঁধের উচ্চতা কচি ধানগাছের উচ্চতা থেকেও কম করা হয়েছে। যা ছোট-খাট বন্যায় সহজেই ডুবে যায়। অষ্টগ্রামে রেগুলেটর জ্যাম হয়ে গেছে। এর ফলে দুটি রেগুলেটরের সঙ্গে বাঁধের সংযোগের উচ্চতার চেয়ে প্রায় ৩-৪ ফুট কমে গেছে। অর্থাৎ বাঁধের সঙ্গে যথাযথ সংযোগ নেই।
শুধু তাই নয়, ড্রেনেজ আউটলেট থেকে প্রবাহিত হওয়া পানি পরিবহনের জন্য স্থানও নেই। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় খালের গভীরতা কমে বর্তমানে ড্রেনের মতো হয়ে গেছে। এ খালের মধ্যে ধান চাষ করা হচ্ছে। অর্থাৎ খালের পাশের বাঁধগুলোর উচ্চতা পাশের ফসলি জমির সমান হয়ে গেছে।
এভাবে বিভিন্ন কাজে ৪৮১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এসব অর্থ ব্যয় করা হয়েছে ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত। যা ২০১৫ সালে বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয়েছে চার বছর। সম্পূর্ণ সরকারি অর্থে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনবার সংশোধন করে ব্যয় কমিয়ে ৫৮৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তাতে বাস্তবে ব্যয় হয়েছে ৪৮১ কোটি টাকা। আর বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। ফলে কাগজে-কলমে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও প্রকৃত সুফল মিলছে না।
সুনামগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান বলেছেন, কোনো রকম দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছাড়াই হাওরে প্রতিবছর অসংখ্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যা বছর ঘুরে না আসতেই নিঃশেষ হয়ে যায়। এতে প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে, সঙ্গে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। এসব কারণে কোনো টেকসই ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল— আগাম বন্যার কবল থেকে হাওর এলাকার বোরো ফসলকে রক্ষা করা, হাওর এলাকার মূল নদীগুলোর পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, অভ্যন্তরীণ খালগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা, দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের নাব্যতা উন্নত করা।
প্রকল্পটির ইতিবাচক দিক হলো— কিশোগঞ্জের ২৮টি হাওরে ১৩ কোটি টাকা ব্যয় করে ৯৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করায় আগাম বন্যার কবল থেকে প্রকল্প এলাকার ৮০ শতাংশ বোরো ফসল রক্ষা পেয়েছে। ওই বছরে এক হাজার কোটি টাকার ধান পাওয়া গেছে।
সিলেট জেলার ছয়টি উপজেলা, সুনামগঞ্জের ১১টি, মৌলভীবাজারের দুটি, হবিগঞ্জের তিনটি, কিশোরগঞ্জের দুটি ও নেত্রকোনার পাঁচটি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
প্রকল্পটিতে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ায় আইএমইডি দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে হাওর এলাকা ভিন্নধর্মী ভৌগোলিক এলাকা। প্রতি বছরই আগাম বন্যা ঠেকাতে এখানে প্রকল্পের পর প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো টেকসই বা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে না।
সূত্র : ঢাকাপ্রকাশ