হবিগঞ্জ শহর ও আশপাশে জলাবদ্ধতা তীব্র আকার ধারণ করেছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টিতে শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা ও কৃত্রিম বন্যা। শহরের উঁচু নিচু এলাকা জলামগ্ন হচ্ছে অহরহ। ঘর-বাড়ি, দোকানপাটে ঢুকছে বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির পানির প্রধান আধার পুরাতন খোয়াই নদী, পুকুর, জলাশয়, খাল দখল-ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে হবিগঞ্জ জলাবদ্ধতার শহর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
বান, বন্যা থেকে হবিগঞ্জ শহর রক্ষার জন্য নদী খনন প্রকল্পের মাধ্যমে খোয়াই নদীকে ‘লুপ কাটিং’ তথা আঁকাবাঁকা সোজাকরণ এর মাধ্যমে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করা হয় ’৭০ দশকের শেষ দিকে। ফলে শহরের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত খরশ্রোতা খোয়াই শান্ত হয়ে থেকে যায়। এটির নাম হয় পুরাতন খোয়াই নদী। এই নদীটি বৃষ্টির পানি, অন্যান্য পানি নিষ্কাশন ও নদী পাড়ে যাতায়াত ও সুন্দর পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ভূমি দখলকারীদের অবৈধ দখলের কারণে পুরাতন খোয়াই নদী বিলীন হয়ে যাওয়ার পথে। ফলে জলাবদ্ধতাসহ পরিবেশ বিপর্যয় হুমকীস্বরূপ।
বর্ষা মৌসুমে শহরের বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট অল্প বৃষ্টিতেই পানির নিচে তলিয়ে যায়। পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম পুরাতন খোয়াই নদী দখল-ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এমনটি হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার জনগণকে ময়লা আবর্জনা মিশ্রিত পানির সঙ্গে বসবাস করতে হয়। প্রায় গত দেড় দশক ধরে চলে আসা জলাবদ্ধতার এই চিত্র চরমে পৌছেছে।
জলাবদ্ধতা, পরিবেশ বিপর্যয় সব মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে হবিগঞ্জে। ‘লুপ কাটিং’ এর আগে স্থান ভেদে খোয়াই নদীর প্রশস্ততা ছিল ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট এবং গভীরতা ছিল ২৫ থেকে ৪০ ফুট। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদীর অধিকাংশ দখল-ভরাট হয়ে গেছে। সরকারি, বেসরকারি, প্রভাবশালী, সামাজিক সংগঠনের নামে এবং নদীর উভয় পাড়ের মানুষ নদীটিকে দখল করে নিজেদের আয়ত্বে নিয়েছে। ফলে জলাবদ্ধতাসহ নানারকম পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে।
পুকুরের শহর নামে খ্যাত হবিগঞ্জ দিন দিন পুকুর শূণ্য হয়ে পড়েছে। ভরাট, দখল ইত্যাদি কারণে গত দেড় দশকে অনেক পুকুর হারিয়ে গেছে এবং অনেক পুকুর ভরাটের নকশা তৈরি হচ্ছে।
এক সময় এই শহরে ট্রেন চলাচল করতো। ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রায় এক দশক আগে রেল লাইনের উপর নির্মিত হয়েছে বাইপাস সড়ক। বাইপাস সড়কের উভয় পাশে এবং শহরের প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় খাল ছিল। এগুলোও দখল ভরাট হয়ে গেছে। যেজন্য বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের সকল মাধ্যম পুকুর, নদী, খাল, জলাশয় হারিয়ে জলাবদ্ধতা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
পুরাতন খোয়াই নদী, পুকুর, জলাশয় রক্ষায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা, খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপারসহ পরিবেশবাদী সংগঠন এবং নাগরিক সমাজ গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে আন্দোলন করেছে। আন্দোলনের ফলে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পুরাতন খোয়াই নদী রক্ষায় একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির উদ্যোগে পুরাতন খোয়াইয়ের একাংশের অবৈধ দখলের সীমানা চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয় নদীর উভয়দিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও খননের জন্য। কিন্তু শুরুতেই কাজটি থেমে যায়!
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জেলা প্রশাসন জলাবদ্ধতায় নাকাল হবিগঞ্জ শহরকে রক্ষার জন্য পুরাতন খোয়াই নদী দখলমুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। মাছুলিয়া থেকে শায়েস্তানগর পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার এলাকা থেকে দখল উচ্ছেদ করা হয় ঐ সময়। তখন খোয়াই এবং পুরাতন খোয়াই নদীকে কেন্দ্র করে বড় একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। হবিগঞ্জবাসী আশার আলো দেখেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন সময়ে জেলা প্রশাসককে বদলী করার সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় উচ্ছেদ অভিযান।
জলাবদ্ধতা, পানি নিষ্কাশন ও পরিবেশ বিপর্যয়ে মানুষ আতঙ্কিত ও উৎকন্ঠিত। হবিগঞ্জের জলাবদ্ধতা, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে অপরিহার্য পুরাতন খোয়াই ও পুকুর, জলাশয়, খাল রক্ষার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা নজরে পড়ছে না। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো আন্দোলন ও সচেতনা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। কিন্তু দায়িত্বশীল মহলের কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। জনপ্রতিনিধি, সরকারের কর্তাব্যক্তি ও সচেতন সুধী সমাজ যথাযথ ভ‚মিকা পালন না করলে জেলার সার্বিক পরিবেশ-প্রতিবেশ, জনজীবন ও জীববৈচিত্রের উপর যে দীর্ঘস্থায়ী মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য।
- তোফাজ্জল সোহেল। সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), হবিগঞ্জ শাখা
নির্বাহী সদস্য কেন্দ্রীয় কমিটি, খোয়াই রিভার ওয়াটারকিপার।