১৯৪৭ সালে দখলদার বৃটিশ রাজশক্তি ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হলে থেকে এই উপমহাদেশ বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান এ দু’টি দেশের জন্ম হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে হতাশ হয়ে পড়ে বাঙালি জাতি। প্রত্যাশা পূরণ তো দূরের কথা শুরু হয় বৈষম্য। সরকারের দমননীতি, পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সীমাহীন বৈষম্য, বাংলা ভাষার প্রতি পাকিস্তানীদের বৈরী আচরণসহ নানা কারণে মুসলিম লীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীরাও মর্মাহত হয়ে পড়েন। গড়ে ওঠে বিভিন্ন দল।
এমনই একটি পদক্ষেপে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। যে দলটি তার ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড দিয়ে দিনে দিনে মহীরুহে পরিণত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি করে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।
৪৭ পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগের সমর্থিত বামধারার কয়েকজন নেতা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ‘পিপলস ফ্রিডম লীগ’, ও পরে ‘গণআজাদী লীগ’ গঠন করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ এর মে মাসে ঢাকায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি বিরোধী দল গঠনের জন্য আলোচনা করেন।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন পূর্ব নির্ধারিত ঢাকার টিকাটুলির কে.এম.দাস লেনের কাজি মোহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের রোজ গার্ডেন বাসভবনে কর্মী সম্মেলন হয়। এতে এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান, আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ, মওলানা ভাসানী, কামরুদ্দিন আহমদ, মওলানা রাগীব আহমদ, খান সাহেব ওসমান আলী, খয়রাত হোসেন, অলি আহাদ, শেখ আবদুল আজিজ, কাজী গোলাম মাহবুব, এ মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আনোয়ারা খাতুন, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, আবদুল খ্রিষ্টাব্দাম খান প্রমুখ যোগ দেন।
সভায় সর্বসম্মতভাবে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে একটি দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ সময় জেলে ছিলেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি এবং শামসুল হককে সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে লেখা বইয়ে লেখক, রাজনৈতিক গবেষক ও পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।
এতে বলা হয়, তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রস্তাব অনুযায়ী সেই দলের নামকরণ করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সেই সঙ্গে পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম রাখা হয় ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’, যার সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
নবগঠিত এ দলটিতে সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, আলী আমজাদ খান, আহমেদ আলী খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আবদুস সালাম খান। ট্রেজারার হন ইয়ার মোহাম্মদ খান। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থেকেও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৫৫ আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। আর পূর্ব পাকিস্তান শব্দ দুইটি বাদ পড়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর থেকে প্রবাসী সরকারের সব কাগজপত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নাম ব্যবহার হতে শুরু করে।
বিবিসিতে উল্লেখ করা ‘মহিউদ্দিন আহমদ’ এর লেখা থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান শেখ মুজিবুর রহমান। পরের বছর ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। যদিও এর মধ্যেই ১৯৫৭ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগে ভাঙন দেখা দেয়।
সে সময় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিলের দাবি করছিলেন মওলানা ভাসানী, কিন্তু তাতে রাজি হননি প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী। ওই মতবিরোধের একটা পর্যায়ে এসে টাঙ্গাইলের কাগমারিতে দলের যে সম্মেলন হয়, সেখানে মওলানা ভাসানীর প্রস্তাবটি ভোটাভুটিতে হেরে যায়। এরপর ১৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন মওলানা ভাসানী। সেই বছর ২৫শে জুলাই তিনি ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করেন। ইয়ার মোহাম্মদ খানও তার দলে যোগ দেন। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ।
১৯৬৪ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর কাউন্সিল সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। কিন্তু ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করার পর মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই তার বিরোধিতা করেন। ওই বছর মার্চ মাসে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে যান। এই দল এবং নেত্বেতের অধীনেই সৃষ্টি হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সূত্র : নিউজবাংলা টুয়েন্টিফোর