১৮ বছরেও চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলার। ২০১৮ সালে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর কেটে গেছে প্রায় চার বছর। তারপর থেকে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদন) মামলা শুনানির জন্য উচ্চ আদালতে অপেক্ষমান আছে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ করেই চালানো হয় ইতিহাসের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। নজিরবিহীন ওই হামলায় গ্রেনেডর স্প্লিন্টারে আহত হন শেখ হাসিনাসহ দলের শীর্ষ নেতারা। প্রাণ হারান আওয়ামী লগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভী রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ঘটা সেই বর্বরতম গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ‘জজ মিয়া’ কাহিনীর জন্ম দেওয়া হয়। নানা অপতৎপরতা চালায় জড়িতরা।
পরবর্তীতে এক-এগারোয় ক্ষমতায় আসা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে গ্রেনেড হামলা মামলা নতুন করে তদন্ত শুরু করে। ২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের বিশেষ শাখা (সিআইডি)। তাতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু হয়। তাতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। সব মিলিয়ে মোট ৫২ জনে আসামির নাম আসে অভিযোগপত্রে।
দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষ্য-প্রমাণের পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার টাইব্যুনাল এ মামলার রায় প্রদান করে। এই রায়ের আগেই মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হয় মামলার অন্যতম আসামি জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে গ্রেনেড হামলার দায়ে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল আলম বিপুলের ফাঁসি কার্যকর হয়। তিন জন আসামির মৃত্যু হওয়ায় বিচার হয় ৪৯ জনের। রায়ে ৪৯ আসামির মধ্যে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপর ১১ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয় আদালত।
রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে কারা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যান মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এনএসআইর সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রহিম। দণ্ডিতদের মধ্যে ৩৩ আসামি কারাগারে রয়েছেন। আর১৫ জন এখনও পলাতক।
পলাতক আসামিরা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, কুমিল্লার মুরাদনগরে বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ টি এম আমিন আহমদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, মহিবুল মুত্তাকিন, আনিসুল মোরসালিন, মোহাম্মদ খলিল, মাওলানা লিটন, জাহাঙ্গির আলম বদর, মুফতি শফিকুর রহমান (যাবজ্জীবন), মুফতি আব্দুল হাই ও রাতুল আহমেদ বাবু।
দণ্ডপ্রাপ্ত বাকি ৪৯ জনের মধ্যে একজন কারাগারে মারা যান। বাকি ৪৮ জনের মধ্যে ৩৩ জন কারাগারে থাকলেও ১৫ জন এখনো পলাতক।
মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) এ এম আমিন উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এই বিষয়ে আমি গত সপ্তাহেও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আগস্টের নৃশংস ঘটনাগুলোতে হওয়া মামলাগুলো (১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা) খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছি। আমরা সেই অবস্থানেই আছি।
জজ মিয়ার আইনি নোটিশ :
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার করা মামলায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিনা অপরাধে চার বছর কারাভোগ করেন মো. জালাল ওরফে জজ মিয়া। এতে তার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার অভিযোগ তুলে তিনি ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতি একটি আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন।
গত ১১ আগস্ট স্বরাষ্ট্রসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফজ্জামান বাবর, পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক খোদা বকশ চৌধুরী, সহকারী পুলিশ সুপার আবদুর রশীদ, মুন্সী আতিকুর রহমান ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিনসহ ১১ ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রি ডাকযোগে জজ মিয়া এই নোটিশ পাঠান।
নোটিশে জজ মিয়ার কারাভোগের জন্য দায়ীদের নিরূপণে ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। তাতে যাদের দায় পাওয়া যাবে তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে জজ মিয়াকে দিতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে লুৎফুজ্জামান বাবরসহ জড়িত ব্যক্তিদের স্থাবর সম্পত্তি জব্দেরও দাবি জানানো হয়েছে নোটিশে। নোটিশ পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে উচ্চ আদালতে রিট করাসহ প্রয়োজনীয় আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জজ মিয়ার আইনজীবী হুমায়ন কবির পল্লব।
এই বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল গত ১১ আগস্ট তার দপ্তরে জজ মিয়া সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, জজ মিয়াকে নিয়ে এই মামলার রায়েও বলা হয়েছে। আর এই নিয়ে তিনি মামলা করলে সেটিও আমরা আইনিভাবে দেখবো।
সূত্র : ঢাকা প্রকাশ