১৩ হাজারে খাট, ৪ হাজারে চেয়ার; তবুও ২ মাসে ঘুণ

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত শেখ হাসিনা হলের জন্য সরবরাহকৃত আসবাবপত্রের একেকটি খাটের দাম ১৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং একেকটি চেয়ারের দাম ৪ হাজার ৩৫ টাকা করে ধরা হলেও সরবরাহের দুই মাসের মাথায় ঘুণে ধরেছে তাতে। এতে আসবাবপত্র কেনায় অসাধু যোগসাজশ থাকতে পারে বলে অভিযোগ তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে উপাচার্যের দাবি, আসবাবপত্রগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের সেরা মানসম্পন্ন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এস. এম. শহিদুল ইসলাম বলেন, আসবাবপত্র কেন ঘুণে ধরেছে এটা ওরা (ঠিকাদার) আসলে দেখাবো। যদি সমস্যা হয়ে থাকে তাহলে এটা ওরা রিটার্ন (ফেরত) নেবে।

চলতি বছরের ৩১ জুলাই আসবাবপত্র ছাড়াই শেখ হাসিনা হল উদ্বোধন করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। হল উদ্বোধনের আগে এ হলসহ আর কয়েকটি ভবনের জন্য ৭১ লাখ ৭৫০ টাকার প্রকল্পের চুক্তির আওতায় মেসার্স আবু জাহের মৃধা নামক একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আসবাবপত্র সরবরাহ করতে থাকে। তবে তাদের আসবাবপত্রের মান ভালো না হওয়ায় ও প্রশাসনের দেয়া শর্ত পূরণ না করার অভিযোগে তাদের সাথে চুক্তি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ।

এরপর চলতি বছরের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএফআইডিসি) ইষ্টার্ণ উড ওয়ার্কসকে ১ কোটি ১০ লাখ ৮ হাজার ৭৭ টাকায় একই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য কার্যাদেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয়। কার্যাদেশ অনুযায়ী ১৯ আগস্ট থেকে হলে আসবাবপত্র সরবরাহ করতে থাকে তাঁরা। তবে আসবাবপত্র সরবরাহের দু’মাস না যেতেই মানহীন আসবাবপত্র সরবরাহের অভিযোগ ওঠে তাঁদের বিরুদ্ধে।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মতে, রাবার কাঠ বিভিন্ন ধরনের হয়। এখানে হয়তো ভালো মানের রাবার কাঠ দেয়া হয়নি বা অন্য কোনো ক্রুটি ছিল।

এদিকে প্রথম দরপত্রে ৭১ লাখ ৭৫০ টাকা ব্যয়ে আকাশি কাঠের আসবাবপত্র সরবারহের জন্য কার্যাদেশ দিলেও পরবর্তী দরপত্রে দেড় গুণ বেশি ব্যয়ে রাবার কাঠের আসবাবপত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয় কর্তৃপক্ষ।

তবে কাঠের আসবাবপত্র বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আকাশি কাঠের চেয়ে রাবার কাঠের মূল্য কয়েকগুণ কম। রাবার কাঠের গুনাগুণ ভালো না হওয়ায় এ কাঠ অধিকাংশ সময় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রথম দরপত্রে হলের প্রতিটি খাটের মূল্য ১২ হাজার ৪৯৫ টাকা দর ধরা হলেও পরবর্তী দরপত্রে প্রতিটি খাটের দাম বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এভাবে চেয়ারের দর ৩ হাজার ৮৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪ হাজার ৩৫ টাকা, ডাইনিং চেয়ার ১০ হাজার ৯৫০ থেকে ১৫ হাজার টাকা এবং লাইব্রেরি টেবিল ১০ হাজার ৮৩৫ থেকে বাড়িয়ে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে বিপরীতে রিডিং টেবিলের দাম ৮ হাজার ৯২৫ টাকা থেকে কমিয়ে ৮ হাজার ৮৮৫, ডাইনিং টেবিল ১৭ হাজার ৫০০ থেকে কমিয়ে ১৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছে।

তবে ক্যাম্পাসের আশেপাশের আসবাবপত্রের দোকান মালিকরা দাবি করে তারা জানান, সরবরাহকৃত আসবাবপত্রগুলো মানসম্মত নয় এবং এসব কাঠের মূল্যও এত বেশি হওয়ার কথা নয়। এগুলো সর্বোচ্চ ৬ মাস টিকবে। এছাড়া রাবার কাঠ সকল আবহাওয়া উপযোগীও নয় বলে দাবি করেন তাঁরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ ছাত্রনেতা বলেন, কর্তৃপক্ষের লোকেদের অবৈধ যোগসাজশ না থাকলে দাম বাড়িয়ে নিম্নমানের আসবাবপত্র দিতে পারে না। স্পেসিফিকেশন কমিটির সুপারিশেরও ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে। এটি পুরোটাই কর্তৃপক্ষের সেচ্ছাচারিতার ফসল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো ক্রয় কাজে দরপত্র আহবানের আগে পণ্যের চাহিদা ও বিবরণ তৈরি করে দেয় স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটি। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সেসকল পণ্যের জন্য দরপত্র আহবান করে কর্তৃপক্ষ। তবে স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আগের দরপত্রে আকাশি কাঠ দেয়ার কথা থাকলেও তাদের অজান্তেই পরবর্তী প্রতিষ্ঠানকে রাবার কাঠের আসবাবপত্র সরবরাহের জন্য বলে কর্তৃপক্ষ।

এ ব্যাপারে আসবাবপত্র স্পেসিফিকেশন প্রস্তুত কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. মো. শামিমুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রশাসনকে আকাশি কাঠের আসবাবপত্র কেনার জন্য স্পেসিফিকেশন তৈরি করে দিয়েছিলাম। কমিটির সুপারিশকৃত আসবাবপত্র প্রশাসন কেন দেয়নি, সেটা তারা জানে।

এদিকে পূর্ববর্তী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি বাতিল করলেও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পাওনা মেটায়নি বলে অভিযোগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আজাদ উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছ থেকে ফার্ণিচার না নিয়ে আমার বাজেট বাতিল করেছে। কিন্তু আমার ব্যয়কৃত টাকা তারা দেয়নি। প্রশাসন আমার ৩৫ লাখ টাকা আটকে রেখেছে।

আসবাবপত্র সরবরাহের দু’মাসের মাথায় ঘুণে ধরার বিষয়ে আসবাবপত্র ক্রয় ও বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর (ভারপ্রাপ্ত) কাজী ওমর সিদ্দিকী বলেন, এটা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি হয়েছে। যদি আসবাবপত্রে সমস্যা থাকে, তাহলে ওরা পরিবর্তন করে দিবে।

এসব বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এফ এম আবদুল মঈনের মন্তব্য জানতে গেলে তিনি বলেন, যাচাই বাছাই কমিটি আগেই ফ্যাক্টরিতে গিয়ে যাচাই বাছাই করেছে। এই আসবাবপত্রের কোয়ালিটি ভেরি হাই ও বেস্ট কোয়ালিটি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন ফার্নিচার আগে আসেনি।

তবে আসবাবপত্র যাচাই-বাছাই কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক ড. জি এম মনিরুজ্জামান বলেন, শেখ হাসিনা হলের আসবাবপত্র যাচাই-বাছাই করার জন্য আমার কাছে কোনো চিঠি আসেনি। আমরা যাচাই-বাছাই করিনি। প্রশাসন কোন প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করেছে আমি জানি না।

বিএফএআইডিসি’র ইষ্টার্ণ উড ওয়ার্কস এর ব্যবস্থাপক (চলতি দায়িত্ব) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, আসবাবপত্রগুলো রাবার কাঠের হলে নষ্ট হওয়ার কথা না। আমরাতো রাবার কাঠই দিয়েছি। এই কাঠ ৫০-১০০ বছরেও কিছু হওয়ার কথা না। তবুও আমরা আমাদের ট্রিটমেন্ট ইউনিটের কোন ক্রুটি হয়েছে কিনা এ ব্যাপারে খোঁজ নেব। আর পর্যবেক্ষণের জন্য শিগগিরই টিম পাঠাব। ওরা কোনো সমস্যা দেখলে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।