২০১৭ সালে পুর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর হিসেবে সিলেটের তামাবিল স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। সেসময় থেকে সিলেটের পাথরকোয়ারিতে প্রশাসনের নজরদারি বাড়লে তামাবিল স্থলবন্দরকে টার্গেট করে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। ওই বছরই দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তামাবিল কয়লা ও চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের সভাপতি নির্বাচিত হন ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। এরপর থেকে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেন লিয়াকত আলী সিন্ডিকেট। ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চলে যেতো এই সিন্ডিকেটের পকেটে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তামাবিল স্থলবন্দর সিন্ডিকেট ভেঙে দখলে নেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিনের নির্বাচনবিহীন কমিটিকে দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গাঁ ঢাকা দেন লিয়াকত আলীসহ এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্যরা। তবে লিয়াকত বাহিনী গাঁ ঢাকা দিলেও গত এক মাস তারা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রের চেষ্ঠা করেছে। যার কারণে গত একমাস তামাবিল স্থলবন্দর দিয়ে বন্ধ ছিল আমদানি-রপ্তানী।
অবশেষে সকল ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে বাংলাদেশ-ভারত দুইদেশের ব্যবসায়ীদের যৌথ প্রচেষ্টায় সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) থেকে স্বাভাবিক হয়েছে আমদানি-রপ্তানী কার্যক্রম। সিন্ডিকেটবিহীন বন্দর দিয়ে সোমবার দুপুর ১টা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চুনাপাথর বোঝাই ভারতীয় ট্রাক তামাবিল স্থলবন্দরে প্রবেশ করতে শুরু করে। আজ মঙ্গলবারও (১০ সেপ্টেম্বর) স্বাভাবিক ছিল বন্দরের আমদানি রপ্তানি।
এদিকে দীর্ঘ এক মাসের বেশি সময় পাথর আমদানি বন্ধ থাকার পর পুনরায় চালু হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে শ্রমিকদের মধ্যে। একই সঙ্গে সিন্ডিকেটমুক্ত বন্দর হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যেও প্রাণ ফিরেছে। নতুন উদ্যোমে স্বপ্ন দেখছেন ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব খাটিয়ে তামাবিল কয়লা ও চুনাপাথর আমদানি রপ্তানিকারক গ্রুপের সভাপতি নির্বাচিত হন জৈন্তাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সরওয়ার হোসেন ছেদু। সংগঠনের বিধিমোতাবেক দুই বছর পরপর নির্বাচনের কথা থাকলেও কোনো নির্বাচন দেননি তাঁরা। উল্টো বিধিবহির্ভূতভাবে নতুন সদস্য অন্তর্ভূক্ত করে নিজেদের সিন্ডিকেট আরও শক্ত করেন তারা।
লিয়াকত আলী সিলেট-৪ আসনের সংসদ-সদস্য সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদের ‘স্বঘোষিত’ পিএস (ব্যক্তিগত সহকারী) ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সাবেক এই মন্ত্রীর দাপট ও মদদে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে একচ্ছত্রভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলছিলেন লিয়াকত-ছেদুর কমিটি। শ্রমিক হ্যান্ডেলিংয়ের নামে অবৈধভাবে চাঁদাবাজিসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে তাদের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েন সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যূত্থানে সরকার পতনের পর নানা দূর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তুলে লিয়াকত-ছেদুর কমিটিকে ক্ষমতাচ্যুত করেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। পরে সংগঠনের অফিস নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। পরবর্তীতে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচন ও বন্দরের আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার জনপ্রতিনিধি, গন্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়।
ব্যবসায়ী সূত্র জানায়, বন্দরে আমদানি জটিলতা নিরসনের আগেই একটি ব্যবসায়ী কমিটির নাম আত্মপ্রকাশ করলে নতুন করে জটিলতা দেখা দেয়। এই কমিটি গঠনের ১২ ঘন্টার মধ্যে পাল্টা আরো দুইটি কমিটি আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় অভিযোগ ওঠে সাবেক কমিটির ক্ষমতাচ্যুতরা কৌশলে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করছে। এ নিয়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলতি মাসের শুরুতে জরুরি বৈঠক আহবান করে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি। সেই বৈঠকে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতামতের ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদ ব্যবসায়ী হেনরী লামিনকে প্রধান সমন্বয়ক করে তামাবিলে পাথর আমাদানি স্বাভাবিক করার দায়িত্ব অর্পন করেন। পরে ৩ সেপ্টেম্বর হেনরী লামিনের নেতৃত্বে সাধারণ ব্যবসায়ীরা ভারতের মেঘালয়ের ব্যবসায়ীদের নিয়ে ডাউকি জিরো পয়েন্টে দ্বি- পাক্ষিক বৈঠক করেন। বৈঠকে দুই দেশের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের ঐক্যমতে চুনাপাথর আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) তামাবিল স্থলবন্দরে ডাউকি হয়ে চুনাপাথর বোঝাই ভারতীয় ট্রাক প্রবেশ করতে শুরু করে। এ সময় মেঘালয় চুনাপাথর রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মিস ডলি কংলাহ্’, মিস্টার লবপাতাম, মিস্টার ড্যানিয়েল কংলাহ্সহ মেঘালয়ের ব্যবসায়ীবৃন্দ।
অন্যদিকে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের পক্ষে হেনরী লামিনের নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আব্দুল হাফিজ, ২নং জৈন্তাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম, ব্যবসায়ী বাবলু বখত, রফিকুল ইসলাম শাহপরান, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন, ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান, ইলিয়াস উদ্দিন লিপু, আবদুল আহাদ, কবির আহমেদ, আবদুল আলিম, নাজিম খান, মিসবাউল আম্বিয়া, জাহিদ খান, ইসমাইল হোসেন সহ অন্যান্যরা।
তামাবিল পাথর-কয়লা শ্রমিক সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, শ্রমিকদের মধ্যে যে হতাশা ছিলো তা কেটে গেছে। আশাকরি ব্যবসায়ীদের ঐক্যমতে তামাবিলে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় থাকবে।
এ বিষয়ে তামাবিল স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী আবুল হাসিম বলেন, দীর্ঘদিন পর তামাবিল আওয়ামী সিন্ডিকেট দালালমুক্ত হলো। এখন থেকে তামাবিলে শুধু ব্যবসা ও ব্যবসায়ীদের প্রধান্য দেয়া হবে। এখানে থাকবে না কোনো চাঁদাবাজি৷
তিনি আরো বলেন, বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের নিকট আহবান থাকবে সকল ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন করা। পাশাপাশি বিগত কমিটির নেতৃত্বে যে কোটি কোটি টাকার দূর্নীতি ও সেচ্ছাচারিতা সংগঠিত হয়েছে তা তদন্ত সাপেক্ষে বের করে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও সদস্যপদ বাতিলের আহবান জানান তিনি।
ব্যবসায়ী শামীম আহমদ বলেন, দীর্ঘদিন জিম্মি অবস্থায় ছিল তামাবিল স্থলবন্দর। অবশেষে এ অবস্থার উত্তরণ হয়েছে। খুব দ্রুত সদস্য নবায়ন করে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরই আলোকে উপদেষ্ঠা পরিষদ কাজ করছে।