দেশীয় সংস্কৃতির এক ডজন অনুষঙ্গ বন্ধের পথে

সংস্কৃতিবিরোধী অপপ্রচার করছে জঙ্গিরা

হলি আর্টিজান হামলার পর দেশে বড় কোনও জঙ্গি হামলা হয়নি। মনে হতে পারে, দেশে জঙ্গি নির্মূল হয়েছে, বাংলাদেশ এখন জঙ্গিমুক্ত। তবে দেশে জঙ্গি হামলার ইতিহাস বলে— পরিকল্পনা পরিবর্তন করে জঙ্গিরা ধারাবাহিকভাবে আঘাত করেছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘সাদাচোখে জঙ্গি হামলা না থাকলেও তারা বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতি, সাহিত্য, উৎসব, বিভিন্ন রেওয়াজ, আঞ্চলিক কর্মকাণ্ড ও সংস্কৃতি চর্চাকারী মানুষের ওপর আঘাত করছে। তারা চেষ্টা করছে প্রচলিত সংস্কৃতির বিরুদ্ধে জনমত গড়ার।’

হলি আর্টিজান হামলার পর কোণঠাসা হয়ে পড়া জঙ্গি সংগঠনগুলো দৃশ্যমান কোনও আঘাত না করতে পারলেও তারা এই কৌশল নিয়েছে। এমনকি শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে কী পাঠদান করছেন- তা নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষকে উসকে দিচ্ছে চক্রটি।

জঙ্গিদের সংস্কৃতিবিরোধী অপতৎপরতার কারণে দেশ থেকে অন্তত এক ডজন দেশীয় সংস্কৃতির অনুষঙ্গ বন্ধ রয়েছে। এরমধ্যে যাত্রাপালা, সার্কাস, পালাগান, বাউল গান, পথনাটক, ঘোড়দৌড়, কীর্তন, ওরস, পুতুল নাচ ও মেলা অন্যতম। নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে শত শত বছরের সংস্কৃতির এসব অনুষঙ্গ বা মাধ্যম চর্চা করতে প্রশাসনও এখন অনুমতি দেয় না। এখানেই জঙ্গি সংগঠনগুলো সফল হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘জঙ্গি সংগঠনগুলো কখনও তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখে না। তারা পরিকল্পনা পরিবর্তন করে এগিয়ে যায়। নিষ্ক্রিয় মনে হলেও তাদের কার্যক্রম বন্ধ নেই।’

হেফাজতের উত্থানের পর দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় মানুষের মনে ভীতি প্রবেশ করে। এরপর ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর এসব সংস্কৃতির মাধ্যম উদযাপনের অনুমতিই মিলছে না। হলি আর্টিজান হামলার পর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একযোগে অভিযান পরিচালনা করে। এতে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যায় জঙ্গি সংগঠনগুলো। তবে তারা ইন্টারনেট দুনিয়ায় বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার বিরুদ্ধে প্রচারণায় লিপ্ত রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘আমরা পর্যবেক্ষণ করছি, উগ্র ও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য যারা রেডিক্যালাইজড হয়েছে, তারা আমাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। জঙ্গিবাদ এমন একটি বিষয়, যা কখনও নির্মূল হবে না। নিয়ন্ত্রণে থাকবে। তবে যারাই থাকবে তারা তাদের তৎপরতা সবসময় চালাবে। তারা এখন হামলার সক্ষমতা হারিয়েছে কিন্তু বিভিন্ন বিষয় উসকে দিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়।’

সাম্প্রতিক টিপকাণ্ড এবং একজন শিক্ষকের বিজ্ঞান পাঠদান নিয়েও উগ্রবাদীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘টিপ পরার কারণে একজন নারীকে সড়কে গালি শুনতে হয়েছে। সেই বিষয়টি নিয়ে উগ্রবাদীরা নেট দুনিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আবার শিক্ষক ক্লাসে বিজ্ঞানে কী পড়াচ্ছেন তা নিয়েও তারা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পৃথিবীজুড়ে যেখানেই জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সেখানেই সেই দেশের সংস্কৃতি, স্থাপত্য, সাহিত্য ও পুরাকীর্তির ওপর আঘাত এসেছে। বাংলাদেশেও হয়েছে, বর্তমানে উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িতরা তা করছে। জঙ্গিরা কখনও নিশ্চুপ থাকে না। তার কয়েক বছর পরপর জাতির ওপর আঘাত হানার কৌশল পরিবর্তন করে কেবল। তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।’

জিয়া রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো ৫/১০ বছর বিরতি দিয়ে দিয়ে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়ে থাকে, এরপর তারা তাদের অপারেশনের কাজটা করে। অতীত ইতিহাস তাই বলে, বাংলাদেশের শক্তিশালী সংস্কৃতিকে তারা তাদের শত্রু মনে করে, তাই তারা এর বিরুদ্ধে কথা বলে।’

সংস্কৃতি বিরোধী অপপ্রচার যেভাবে হয়

সংস্কৃতিবিরোধী প্রচারণা সবসময় গুজব দিয়ে শুরু হয়। এরপর সেটি নিয়ে বিভিন্ন গল্প ছড়ানো হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। সাম্প্রতিক টিপকাণ্ড নিয়ে সরব হয়ে উঠেছিল তারা। এর আগে একজন শিক্ষক ক্লাসে বিজ্ঞান পাঠদানের সময় কি পড়িয়েছিলে, তা নিয়েও জঙ্গিরা হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। এই আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে তারা টেনে নিয়ে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে চক্রটি। এসব বন্ধ করার দাবিও করেছে তারা।

বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদের সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘যে কোনও ঘটনা ঘটলে জঙ্গি ও উগ্রবাদীরা সেখানে সুযোগ নেয়। যাতে অসংখ্য মানুষ সাড়া দেয়। তারা একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের আদর্শটা চাপিয়ে দিতে চায় কৌশলে। দেশের সংস্কৃতি চর্চা মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন ঘটায়। কিন্তু সেইসব মাধ্যম এখন বন্ধ। তাই তারা আরও সুযোগ পেয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা একবার রাজধানীতে দুটি পালাগানের আয়োজন করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন আমাদের রাত ৯টার মধ্যে সব বন্ধ করে দিতে বললো। অথচ পালাগান শুরুই হয় রাত ৯টায়, শেষ হয় গভীর রাতে। আমাদের এভাবে সংকুচিত করে দেওয়া হয়েছে।’

অমিত রঞ্জন দে বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে আমাদের দেশে এই চক্রান্ত শুরু হয়েছে। হেফাজতের দাবিনামা গোপনে সরকার মেনে নিয়েছে বলে মনে হয়, তা না হলে কেন মানুষকে সংস্কৃতি চর্চা করতে অনুমতি দিচ্ছে না। সরকার নিজেকে সংস্কৃতিবান্ধব বললেও আসলে ভেতরে-ভেতরে সংস্কৃতিবান্ধব না। কারণ তারা সংস্কৃতি কর্মকাণ্ডকে সংকুচিত করে দিয়েছে। বাজেটে মাত্র দশমিক ০৯ শতাংশ বরাদ্দ থাকে সংস্কৃতি খাতে, তাও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন ভাতার খরচে চলে যায়। সংস্কৃতির উন্নয়নে কোনও ব্যয় হয় না।’

গভীর অস্তিত্ব সংকটে সংস্কৃতির এক ডজন মাধ্যম

যাত্রাপালা, সার্কাস, পালাগান, বাউল গান, পথনাটক, ঘোড়দৌড়, কীর্তন, ওরস, পুতুল নাচ ও গ্রাম্যমেলা অস্থিত্ব সংকটে ভুগছে। এরমধ্যে কিছু অনুষঙ্গ আর উদযাপিত হয় না।

এর কারণ বলতে গিয়ে বাংলাদেশ যাত্রা শিল্প উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি মিলন কান্তি দে বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাই। গ্রামগঞ্জে যাত্রাপালা করার অনুমতি চাই, কিন্তু পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) অনুমতি দেন না। প্রধানমন্ত্রী গ্রামগঞ্জে সংস্কৃতি ছড়িয়ে দিতে বলেন অথচ প্রশাসন আমাদের নানা অজুহাতে এসব উদযাপনের অনুমতি দেয় না।’

তিনি বলেন, ‘যাত্রার সংলাপের যে শক্তি তা মৌলবাদীরা বুঝেছে। তাই তারা এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীনকাল থেকে এসব মাধ্যম গ্রামীণ জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি লোকজীবনের সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন তা হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করেও পাচ্ছি না। কারণ আমাদের সংস্কৃতির লোকজনকে অন্য সেক্টরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এখন সংস্কৃতি চর্চা ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।’

ফিরিয়ে আনার এখনও সময় আছে

উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ রুখতে লোকসংস্কৃতির এই মাধ্যমগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য প্রয়োজন বলে মনে করছেন সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ।

তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল সমস্যা হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এখনও অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দল হতে পারেনি। উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ এই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে যায়। এ থেকে আমাদের বের হতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত সংস্কৃতির জাগরণ দরকার। তাহলে এদের প্রতিহত করা যাবে। এজন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।’

সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প দেখছেন না শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘দেশে উগ্রতা, সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে। একটা ভয়ের সংস্কৃতি চলছে। বিজ্ঞান শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে সহজ বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন না। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষা, সংস্কৃতি সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর হবে। সংস্কৃতির একটা প্রতিরোধ গড়তে হবে। তাহলে এই জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন