‘রাত আনুমানিক দুইটা হবে। দুই ছেলে সন্তানদের নিয়ে আমরা তখন গভীর ঘুমে। হঠাৎ করে ঠাসঠাস শব্দ শোনে ঘুম ভাঙে আমাদের। প্রথমে ভেবেছি কেউ সম্ভবত মারামারি করছে। বাচ্চার বাবা (নিহত আমরোজ মিয়া) চোখে ঘুম নিয়ে খাট থেকে লাফ দিয়ে নামেন। সাথে আমিও। দরজা খুলতেই দেখি ঘরের চালে আগুনের লেলিহান শিখা। সবাই ছোটাছুটি করছেন। কেউ পানি আনছেন। আগুন নিভাতে কেউ পানি ঢালছেন। আগুন যাতে চারদিকে না ছড়ায় সেজন্য ছেলের বাবা একটি বাঁশ নিয়ে ঘরকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে মূহুর্তের মধ্যেই একঘর দুই ঘর হয়ে পূর্বের ভিটার ৯টি ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। ছেলের বাবা কোনো কিছু না ভেবেই ঘরের দা দিয়ে বৈদ্যুতিক তার কেটে পশ্চিম ভিটার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। পরক্ষণেই আমার সব শেষ হয়ে গেলো। তারে দা লাগাতেই বিদ্যুতায়িত হন তিনি। উড়ে গিয়ে পড়েন বাঁশের তর্জার (বারান্দায় দেওয়া বিশেষ বেড়া) উপর। তাকে তুলতে আমার বড় ছেলে সালমান আহমদ এগিয়ে গেলে সেও শর্ট খায়। ছোট ছেলে এগিয়ে গেলে সেও শর্ট খায়। বড় ভাইয়েরা এগিয়ে আসার আগেই তিনি শেষ। আমার জীবনের সব আনন্দ মরে গেছে। পূর্বের ভিটায় ঘরটি তৈরি করতে ৬০ হাজার টাকা ধার করেছিলাম। ৩০ হাজার টাকা ব্যাংক লোন আর ৩০ হাজার সুদের।’
এভাবেই ২৩ জুলাই রবিবার দিবাগত রাতের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা দিচ্ছিলেন অগ্নিকাণ্ডের সময় বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া আমরোজ মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম। পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চিকারকান্দি গ্রামের কাজিবাড়ির হাজেরা বেগম স্বামীহারা হয়ে নিঃস্ব চোখে এখন শর্ষেফুল দেখেন। তার দু’টি সন্তানই ছোট। এখন কি করবেন, কোথায় যাবেন এই চিন্তাতেই দিন কাটছে তার।
হাজেরা বেগম স্বামী হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন কিন্তু আহাদ মিয়া, শাবাজ মিয়া, সিতার মিয়া, সেবুল মিয়া, আবদুস সমাদ, রিপন, বজলু মিয়া, ফরিদ মিয়া, আব্বাস আলী, তারিছ মিয়া ও সুজাত মিয়ারা হারিয়েছেন বসতঘর। বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন বৈশাখী ধান, গরু, হাঁস-মোরগ, পড়নের পোশাক-পরিচ্ছেদ আর নগদ টাকা। সব কিছুই গ্রাস করেছে আগুনের লেলিহান শিখা। সহায়-সম্বল বলতে অবশিষ্ট কিছুই নেই ক্ষতিগ্রস্ত ৯টি ঘরে বসত করা ১২টি পরিবারের। তারা বহু কষ্টে দিনাতিপাত করছেন, থাকছেন আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বাড়িতে। খোলা আকাশের নিচে এসে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন আগুনে পুড়া খালি ভিটার উপর। কি করে ঘুরে দাঁড়াবেন, আর কবে নিজের ঘরের ভেতর ঘুমাবেন এসব ভেবে নীরবে চোখের পানি ফেলেন ক্ষতিগ্রস্তরা।
গর্ভবতী স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। ডাক্তাররা বলেছেন সিজার করতে হবে। তাই ধারদেনা করে স্ত্রীর সিজারের খরচ বাবদ ৬০ হাজার টাকা জমিয়ে রেখেছিলেন শাবাজ মিয়া। সেই টাকা ও দু’জনের আমানত রাখা টাকাসহ ১ লক্ষ ৫ হাজার টাকা আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে। এখন কী করবেন এমন চিন্তায় বার বার ভেঙে পড়ছেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত আহাদ মিয়া জানান, পরিবারের ৪জন সদস্য নিয়ে গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। তারা আমাদের খুবই সহযোগিতা করছেন। বলেছেন, যতদিন না নতুনঘর তুলতে পেরেছি ততদিন তাদের ঘরে থাকতে। খুবই কৃতজ্ঞতা তাদের প্রতি। তবুও তো, নিজের ঘরে থাকার আরেকটা আলাদা শান্তি। নিজের ঘরে থাকার আরাম আর প্রশান্তি কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। খাওয়া-খাদ্য কিছুই নাই৷ মানুষ যা দিচ্ছে তা নিয়েই চলছি। খুব কষ্ট হচ্ছে চলতে। পরিবারের ৫জন সদস্য নিয়ে আবদুস সমাদ উঠেছেন তার ফুফু সনতেরা বিবির বাড়িতে।
তিনি বলেন, হাতে টাকা-পয়সা নেই, বাড়ির দলিল, জন্ম সনদপত্র, জাতীয় পরিচয়পত্র, নগদ টাকা ও ভ্যাক্সিনের কাগজসহ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়েছে।
সিতার মিয়া, রিপন মিয়া ও বজলু মিয়া জানান, মাত্র ৩মাস আগে নতুন ঘর তুলেছিলাম। অনেক ধারদেনা করেছিলাম সেসময়। নগদ টাকা, হাঁস-মোরগ ইত্যাদি কিছু অবশিষ্ট নেই। একখান লুঙ্গি দিয়েছেন একজন সেটাই এখন সম্বল।
ফরিদ মিয়া ও আব্বাস আলী জানান, এ বছর ভালো বৈশাখী হয়েছিলো। ধান পেয়েছিলাম। যাদের ঘর পুড়েছে সকলের মিলিয়ে প্রায় ৭শ মন ধান পুড়েছে। শুধুমাত্র শাবাজ মিয়া ও আব্বাছ আলীরই প্রায় ৩শ মন ধান ছিলো। তারা জানান, সাজানো সংসার ছিলো তাদের। এ রাতের অগ্নিকাণ্ডে সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে। নতুন করে জীবন গোছাতে হবে। পোশাক-পরিচ্ছেদ, ছেলে-মেয়েদের স্কুল মাদ্রাসার বই, ঘর তৈরিসহ সবই করতে হবে। এসব ভাবলে রাতে ঘুম আসে না কারো। এমন অমানবিক জীবন কিভাবে যাপন করবেন এই এশ্ন এখন ক্ষতিগ্রস্ত সকলের মুখে মুখে।
৯টি ঘর পুড়েছে ঠিক কিন্তু সেই ৯ ঘরে ১২টি পরিবারের বসবাস। অর্ধশতাধিক সদস্য এসব পরিবারে। সবক’টি পরিবারের মাথার উপর এখন ছাদ নেই। আর হাজেরা বেগমের মাথার উপর ছাদ থাকলেও ছায়া নেই। এ অগ্নিকাণ্ডে স্বামী হারিয়েছেন তিনি, বাবা হারিয়ে তার অবুঝ দুই শিশু। ছাদ-ছায়াহীন এসব পরিবার এখন জীবনের সবচেয়ে বেশি দুর্বিষহ সময় পার করছের। তারা থাকছেন আত্মীয়-অনাত্মীয়ের বাসা-বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া করছেন মানুষের দয়াদাক্ষিণ্যে। এভাবে কতদিন চলবেন তারা? তাদের এই সমস্যার স্থায়ী সামাধান চান সকলেই। সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ, সামাজিক সংগঠন, সরকার ও বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেছেন তারা।
এ ঘটনায় শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান তাৎক্ষণিক নিহত আমরোজ মিয়ার পরিবারকে ২০ হাজার টাকা সহযোগিতা করেছেন এবং ক্ষতির শিকার হওয়া পরিবারগুলোকে ২শ কেজি চাল দিয়েছেন। এ ছাড়াও পূর্ব পাগলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাসুক মিয়া পুরুষদের জন্য লুঙ্গি ও মহিলাদের জন্য শাড়ি দিয়েছেন। এর বাইরে কেউ কোনো সহযোগিতা করেন নি বলে জানিয়েছেন তারা।
তবে শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ইউপি চেয়ারম্যান সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আনোয়ার উজ্ জামান বলেন, প্রথম দিন আমরা কিছু টাকা ও চাল দিয়েছিলাম। তারপর ব্র্যাকের মাধ্যমে আরও কিছু খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু টাকা দেওয়ারও কথা রয়েছে। এছাড়াও এই সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষতিগ্রস্তদের কিছু টিন এবং আরও কিছু নগদ টাকা দেওয়া হবে বলে আশা করছি। উপজেলা পরিষদেরও ফান্ড আছে প্রয়োজনে আমরা সেখান থেকেও দেবো।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক নূর হোসেন বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সমবেদনা। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা চেষ্টা করবো তাদেরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ বলেন, উপজেলা পরিষদ থেকে আমরা চেষ্টা করছি তাদেরকে সহযোগিতা করার। যত দ্রুত সম্ভব তা করা হবে।