ধরুণ একটি কুয়াশার সকাল আর এর শুরু কেবল লবণ মিশ্রিত চা দিয়ে! তাহলে সকালের শুরুটা কেমন হবে? ভাবছেন চিনির বদলে লবণ কেন? প্রশ্নটির উত্তর দিলেন ‘বুরজান’ চা বাগানের শ্রমিক সুরাই লাল। জানালেন, ক্লান্ত দেহ চাঙা করা কিংবা অলসতা দূর করার এক মহা ঔষধ লবণ মিশ্রিত চা। যাকে চা শ্রমিকরা ‘লবণ চা’ হিসেবেই চেনেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা চা শ্রমিক। আমাদের চিনি কিংবা দুধ খাওয়ার সাধ্য নাই। দিনের শুরুটা যেমন শ্রমিকদের এই চায়ের সাথে হয় দিন শেষের ক্লান্ত শরীরের ব্যথা নিবারণেও যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে এই চায়ের প্রচলন।’
এই ‘লবণ চা’ নামেই চা শ্রমিকদের জীবনের গল্প ছবির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেছেন আলোকচিত্রী রেজোয়ানা চৌধুরী জিনিয়া।
বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) বিকাল পাঁচটায় সিলেটের খাদিম চা বাগানের বুরজান চা কারখানার খাদিমনগর, পূজামন্ডপে রেজোয়ানা চৌধুরী জিনিয়ার প্রথম একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন হয়। সাধারণ চা শ্রমিকদের দিয়ে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়।
প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে ৪১টি ছবি। প্রতিটি ছবি তোলা হয়েছে সিলেট অঞ্চলের চা বাগান এলাকা থেকেই। প্রদর্শনীটি সবার জন্য উন্মুক্ত চলবে ১৯ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রদর্শনীর ডিজাইন করেছে কালী কালেক্টিভ এবং এর পোস্টার ডিজাইন করেছেন সব্যসাচী হাজরা।
কোন ছবিতে কুয়াশার সকালে মাথায় বোঝা নিয়ে চা শ্রমিক নারীর ছুটে চলা, কোথাও সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা কিংবা চা শ্রমিক তরুণীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ভাবনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। না জানা গল্প বলা এই ছবিগুলো ঘিরে চা শ্রমিকদেরও বেশ আগ্রহ দেখা গেছে।
বিকালে সপ্তাহিক হাজিরা (দৈনিক বেতন) প্রাপ্তির পর শ্রমিকরা ঘরে ফেরার সময় ছুটে আসেন এসব ছবি দেখতে। এসময় কথা হয় চা শ্রমিক সন্তান মিন্তি নামের এক তরুণীর সাথে। তিনি বলেন, আপা (জিনিয়া) অনেক দিন থেকে আসেন। আমাদের সাথে সম্পর্ক হয়েছে। ছবি তোলেন। উনার মত অনেকে ছবি তোলে। কিন্তু আমাদের কেউ দেখায় না। এখন দেখলাম। ভালো লাগছে।
তবে কিছুটা অধিকার সচেতন কথা বললেন শ্যামলাল নামের এক তরুণ। তিনি বলেন, আমরাও জানি না আমাদের কতটা রক্ত চুষে খাওয়া হচ্ছে। চায়ের রঙ লাল এটাতো আমাদের রক্ত৷ ছবিগুলো দেখলে বুঝবেন আমাদের জীবন কেমন।
আলোকচিত্রী রেজোয়ানা চৌধুরী জিনিয়া বলেন, আমি প্রায় এক দশক ধরে এই ছবিগুলো তুলেছি। সিলেট অঞ্চলে বিভিন্ন জনপদে, ভিন্ন ভিন্ন চা বাগানে ছবিগুলি তোলা। ছবি তোলার বড় একটা সময় খাদিম নগর ও বুরজান চা ফ্যাক্টরির আওতায়, ছড়া গান, বুরজান, কালাগুল, গুলনি চা বাগানে এবং শ্রীমঙ্গলের বিভিন্ন চা বাগানে কাজ করেছি। এখানকার মানুষ আমার প্রিয়।
চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করার আগ্রহের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় আমার বাবা সিলেটের একটি বাগানে তিন মাস ম্যানেজার ছিলেন। যার কারণে আমি ছোট থেকে মার মুখ থেকেই চা শ্রমিকদের জীবনের গল্প শুনে বড় হয়েছি। কিন্তু আমি সচরাচর চা শ্রমিকদের যেসব ছবি দেখি সেগুলোর সাথে আমার মায়ের বলা গল্পের মানুষগুলোর জীবনের মিল পাই না। এজন্য এই মানুষগুলোকে জানতেই আমি চা বাগানগুলোতে ঘুরে বেড়ানো শুরু করি। আমার চলার ফাঁকে ফাঁকে তাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্পগুলো ক্যামেরায় ধারণ করি। এবং আমার উদ্দেশ্যে ছিলো যাদের ছবি তোলেছি তাদেরকেই প্রথম দেখাব। এজন্যই এখানে আমার প্রদর্শনী।
প্রর্দশনীর নামকরণ নিয়ে তিনি বলেন, বিলাসী চা এর দুনিয়ায় খুব সম্ভবত সবচেয়ে নিম্ন স্বাদের চা “লবণ চা”। এই চা শুধু স্বাদ নয়, সমাজে শ্রেণীও নির্ণয় করে। চিনি, দুধ সহ যাবতীয় চায়ের উপকরণ যাদের সামর্থের বাইরে তারাই খান লবণ চা। লবণ চা খাওয়ায় ইতিহাসও চা শ্রমিকদের জীবনীর মতোই দীর্ঘ। দুইশত বছরের সুপরিকল্পিত শোষণ কি ভীষণ শিকড় গেড়েছে শ্রমিকের জীবনবোধ এ! যা সাদা চোখে দেখে বোঝা কঠিন। এখানে শ্রমিকদের ঘাতে- প্রতিঘাতে- সংঘাতে বেঁচে থাকার লড়াইটাই শুধু আসল। চা শ্রমিকদের দিনের শুরু হয় লবণ চা পান করে। এইসব কারণে লবণ চা শিরোনাম করেছি।