লঙ্কানদের রানপাহাড় ডিঙিয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়া জয় পেল পাকিস্তান। ১০ বল হাতে রেখেই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান টপকানোর রেকর্ড গড়ে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লো বাবর আজমের দল।
বলের পর ব্যাট হাতেও হতাশার এক ম্যাচের দিকে এগোচ্ছিল পাকিস্তান। শ্রীলঙ্কার ৩৪৫ রানের জবাবে ইমাম-উল-হক ও বাবর আজম দুজনেই ফিরে যান দলীয় ৩৭ রানে। এরপর যা ঘটেছে– সেটি পাকিস্তান কেন ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট! লঙ্কান ব্যাটার কুশল মেন্ডিস ও সাদিরা সামারাবিক্রমার জোড়া সেঞ্চুরির জবাবে পাকিস্তানি ব্যাটার মোহাম্মদ রিজওয়ান এবং আব্দুল্লাহ শফিকও ম্যাজিক ফিগার পূর্ণ করেছেন। যার ওপর ভর করে ১০ বল হাতে রেখেই জয় পায় পাকিস্তান। আর তাতে টানা দ্বিতীয় পরাজয়ে হতাশায় পড়লো শ্রীলঙ্কা।
তুলনামূলক দুর্বল দল নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয়ের পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান। আজ (মঙ্গলবার) আগে ব্যাট করা দাসুন শানাকার দলের বিপক্ষে তারা বাজে বোলিংয়ের পসরা বসিয়েছিল। প্রায় সব বোলারই রান দিয়েছেন ওভারপ্রতি ৬-এর বেশি গড়ে। অন্যদিকে লঙ্কানরা আগের ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৪২৮ রানের পাহাড়ের সামনে পড়ে যায়। যদিও এরপর তারা ৩২৬ রান করে লড়াই চালিয়েছিল।
হায়দরাবাদের রাজিব গান্ধী স্টেডিয়ামে আগে ব্যাট করতে নেমে কুশল মেন্ডিস ও সাদিরা সামারাবিক্রমার জোড়া সেঞ্চুরিতে লঙ্কানরা ৩৪৫ রানের বড় লক্ষ্য দাঁড় করায়। এরপর রানতাড়ায় নেমে চতুর্থ ওভারেই ব্যক্তিগত ১২ রানে ফিরেন পাকিস্তানি ওপেনার ইমাম। দিলশান মাদুশঙ্কার শর্ট লেংথের বাউন্স বল খেলতে গিয়ে তিনি কুশল পেরেরার হাতে ক্যাচ দিয়েছেন। প্রথম ম্যাচে ব্যাট হাতে ব্যর্থতার পর আজও রান পাননি পাক অধিনায়ক বাবর। বলতে গেলে মাদুশঙ্কার দুর্বল ডেলিভারিতে তিনি নিজের উইকেট তুলে দিয়েছেন সামারাবিক্রমার হাতে। ফিরেছেন ব্যক্তিগত ১০ রানে।
এরপরই নিজেদের খোলস ছেড়ে দারুণ ফর্ম দেখিয়েছেন আব্দুল্লাহ শফিক ও রিজওয়ান। টানা ব্যর্থতার পর এদিন একাদশে জায়গা মেলে শফিকের। এর আগে যখনই সুযোগ পেয়েছেন ব্যাট হাতে দ্যুতি ছড়িয়েছেন এই ২৩ বছর বয়সী ব্যাটার। সেই ধারাবাহিকতায় আরও একবার দায়িত্ব পেয়ে তিনি দলের জন্য জয়ের ভিত গড়ে দিয়েছেন। চতুর্থ ওয়ানডে খেলতে নেমেই দেখা পেয়েছেন প্রথম সেঞ্চুরির। যদিও এরপর বেশিক্ষণ আর ক্রিজে টিকে থাকতে পারেননি শফিক। ১০৩ বলে তিনি ১০টি চার ও তিন ছক্কায় ১১৩ রানের ইনিংস খেলেছেন।
অন্যদিকে, ফিফটি পূরণ করার পর থেকেই খুড়িয়ে হাঁটছিলেন রিজওয়ান। প্রতি রান-আপেই তাকে বেশ সংগ্রাম করতে হচ্ছিল। তবুও শফিকের সঙ্গে তিনি জুটি গড়েছেন ১৭৬ রানের। এরপর পাকিস্তানের জয় পাওয়াটা কেবল-ই কিছু সময়ের অপেক্ষা মনে হয়েছিল। তবে সেট-ব্যাটসম্যান শফিক আউট হওয়াতে কিছুটা ধাক্কা খান রিজওয়ানরা। এরপর সৌদ শাকিলকে সঙ্গে নিয়ে আরেকটি জুটি গড়েছেন এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। চোটের অস্বস্তি নিয়েও ৯৭ বলেই তিনি ব্যক্তিগত সেঞ্চুরি তুলে নেন। যা তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় শতক।
শেষ পর্যন্ত জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার আগে রিজওয়ান ১৩১ রানে অপরাজিত ছিলেন। ১২১ বলের ইনিংসটি তিনি সাজিয়েছেন ৮টি চার ও তিন ছক্কায়। এর আগে শাকিলের সঙ্গে তার জুটিতে রান আসে ৯৫। ৩০ বলে ৩১ রান করা শাকিলকে ফেরান ইনজুরি থেকে ফেরা স্পিনার মহেশ থিকসানা। তবে তার আগে এই স্পিনারের এক ওভারেই দুটি ক্যাচ ছাড়েন লঙ্কার ফিল্ডাররা। সেই দুটি ক্যাচ ধরতে পারলেও ম্যাচের পরিস্থিতি হয়তো আরও কিছুটা হাড্ডাহাড্ডি হতো।
ইফতিখার আহমেদ যখন ক্রিজে নামেন, তখন পাকিস্তানের ৩৩ বলে প্রয়োজন ছিল মাত্র ৩৭ রান। চারটি চারের বাউন্ডারিতে সেটি আরও হাতের নাগালে নিয়ে আসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত ছিলেন ২২ রানে (১০ বল)। পায়ের অস্বস্তি নিয়েও ৬ উইকেটের বড় জয় নিয়ে ম্যাচ শেষ করে ফিরেছেন রিজওয়ান।
লঙ্কানদের হয়ে মাদুশঙ্কা সর্বোচ্চ দুই উইকেট পেয়েছেন। মাথিশা পাথিরানা ও থিকশানা নিয়েছেন একটি করে উইকেট।
এর আগে ব্যাট করতে নেমে লঙ্কানদের শুরুটা সুখকর হয়নি। চোটের অস্বস্তি নিয়ে ওপেনিংয়ে নামা কুশল পেরেরা দলীয় ৫ রানেই ফিরেছেন। হাসান আলীর বলে তিনি কিপার মোহাম্মদ রিজওয়ানের তালুবন্দি হয়েছেন রানের খাতা খোলার আগেই। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি লঙ্কানদের। তরুণ ওপেনার পাথুম নিশাঙ্কার সঙ্গে কুশল মেন্ডিস ১০২ রানের জুটি গড়েন।
মেন্ডিস শুরু থেকেই ছিলেন খুনে মেজাজে, ধীরস্থির ব্যাটিংয়ে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন নিশাঙ্কা। সে ধারাবাহিকতায় মাত্র ১৭ ওভারেই দলীয় একশ পেরোয় লঙ্কানদের ইনিংস। ব্যক্তিগত অর্ধশতক পূর্ণ করে শাদাব খানকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে আব্দুল্লাহ শফিকের হাতে ক্যাচ দেন নিশাঙ্কা। এর আগে ৬১ বলের ইনিংসে তিনি ৭টি চার ও এক ছক্কায় ৫১ রান করেন।
সাম্প্রতি সময়ে দারুণ ফর্মে আছেন মেন্ডিস ও সাদিরা সামারাবিক্রমা। এদিনও এই দুই ব্যাটার নাভিশ্বাস তুলেছেন পাকিস্তানি বোলারদের। তাদের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের বিপরীতে ভুলে যাওয়ার মতো বোলিং করেছেন শাহিন আফ্রিদি ও হারিস রউফরা। তারা লঙ্কানদের দ্রুতগতির রানে বিঘ্ন ঘটাতে পারেননি। বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরি করেছেন মেন্ডিস, সেঞ্চুরি পেয়েছেন সামারাবিক্রমাও।
হাসান আলীর বলে ইমাম-উল হকের অসাধারণ এক ক্যাচে আউট হওয়ার আগে মেন্ডিস করেছেন ১২২ রান। ৭৭ বলের ইনিংসে মেরেছেন ১৪টি চার ও ৬টি ছয়। আউট হওয়ার আগে সামারাবিক্রমার সঙ্গেও শতরানের জুটি গড়েছেন মেন্ডিস। তৃতীয় উইকেট জুটিতে তারা দুজনে তুলেছেন ৬৯ বলে ১১১ রান। মেন্ডিস-ই ছিলেন বেশি আক্রমণাত্মক। এই জুটিতে তার অবদান ৩৭ বলে ৭২ রান। তার পেছনে অবশ্য পাকিস্তানি ফিল্ডার ইমামের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ মাত্র ১৮ রানে থাকাকালেই তিনি মেন্ডিসের ক্যাচ হাতছাড়া করেছিলেন।
পাকিস্তানের হয়ে খরুচে বোলিং করলেও ঠিকই চার উইকেট তুলে নিয়েছেন হাসান আলী। তার বলে সামারাবিক্রমা আউট হওয়ার আগে ৮৯ বলে ১০৮ রানের দারুণ ইনিংস খেলেন। তিনি মেরেছেন ১১টি চার ও দুটি ছক্কার বাউন্ডারি। শেষদিকে লঙ্কানদের সংগ্রহ আরও বাড়তে পারত। কিন্তু শেষ তিন ওভারেই তারা তিন উইকেট হারায়।
হাসান আলী সর্বোচ্চ ৪ উইকেট এবং হারিস রউফ নেন ২ উইকেট। এছাড়া শাহিন আফ্রিদি, মোহাম্মদ নেওয়াজ ও শাদাব খান একটি করে শিকার করেন।