নিখোঁজের ২৯ দিন পর খুলনা নগরের দৌলতপুর থানার মহেশ্বরপাশা এলাকা থেকে মরিয়ম মান্নানের মা নিখোঁজ রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। রহিমা বেগমের ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে নানা জল্পনা চলছিল। তিনি গুমের শিকার হয়েছেন, নাকি তাকে অপহরণ করা হয়েছে, নাকি তিনি নিজেই আত্মগোপনে গেছেন—এরকম নানা শঙ্কা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছিল।
শ্বাসরুদ্ধকর এই কাহিনীতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়, যখন ২৯ দিন পরে মেয়ে মরিয়ম মান্নান এক নারীর লাশকে তার মায়ের লাশ বলে শনাক্ত করেন। কিন্তু পরে দেখা যায়, এটি তার মায়ের লাশ নয়। এর পরপরই রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় ফরিদপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পরে জানা যায়, এই একমাসে রহিমা বেগমের নানা কর্মকাণ্ড। তার নানা দাবির বিপরীতে কিছু প্রশ্ন উঁকি দেয়, যার জবাব তিনি নিজেও যথাযথভাবে দিতে পারেননি বলে মনে করছেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, এধরনের পরিস্থিতিতে মানসিক ভারসাম্য হারানো স্বাভাবিক। কিন্তু তার ও তার মেয়ে মরিয়মের একের পর এক বক্তব্যের অসঙ্গতির কারণে বিষয়টি ঘোলাটে হয়ে গেছে।
শুরু থেকেই মেরে ফেলা হয়েছে, বলা হলো কেন?
ঘটনা ২৭ আগস্ট রাত ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার। বাসার উঠানের নলকূপে পানি আনতে যান রহিমা খাতুন। এক ঘণ্টা পরও তিনি বাসায় না ফেরায় সন্তানরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। এরপর নলকূপের পাশে মায়ের জুতা, ওড়না ও পানির পাত্র পড়ে থাকলেও মাকে খুঁজে পাননি তারা। এরপর থেকে মরিয়ম মান্নান মাকে খুঁজতে থানা, পুলিশ, মন্ত্রী, সাংবাদিকের কাছে গেছেন, মাকে ফেরত চেয়ে আবেদন করেছেন মরিয়ম মান্নান। একাধিক স্থানীয় ও জাতীয় প্রতিবেদকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ে তিনি বারবারই মাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে দাবি করতে থাকেন। একইসঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় সাংবাদিকদের সহায়তা না করার অভিযোগও করেন। কেন মাকে খুঁজতে নেমে মেরে ফেলার শঙ্কায় ছিলেন সে প্রশ্নের জবাব তিনি দেননি।
স্পটে না গিয়ে মায়ের লাশ পাওয়ার স্ট্যাটাস
২৩ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১২টার দিকে মরিয়ম মান্নান ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘আমার মায়ের লাশ পেয়েছি এই মাত্র।’ তখনও তিনি ময়মনসিংহে পৌঁছাতে পারেননি। গলে পচে যাওয়া এবং অপরিচিত পোশাকের ছবি দেখেই তিনি কীভাবে দাবি করলেন এই লাশ তার মায়ের সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মাকে চিনতে সন্তানের ভুল হয় না। কপাল, হাত, মুখ দেখে বুঝছি এই লাশটি আমার মায়ের। পরবর্তীতে রহিমা বেগমকে অক্ষত উদ্ধারের পর এ বিষয়ে জানতে চাইলে মরিয়ম বলেন, এই লাশ যে আমার মায়ের না সেটাই স্বস্তির। আপনাদের খুশি হওয়া উচিত।
প্রতিটি স্ট্যাটাসের বিপরীত পরিস্থিতি উদ্ভূত হলে তিনি ভিন্ন ও নতুন ব্যাখ্যা নিয়ে হাজির হওয়ায় সমালোচিত হচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, যা শুনেছি তাতে তথ্যের ঘাটতি আছে। তবে মরিয়মের অবস্থান পরিষ্কার মনে হয়নি। কথায় অনেক ধরনের অসঙ্গতি। বিশেষ করে সে যখন একটা মৃতদেহ না দেখেই বলতে থাকলো এটাই তার মা, তখন আরও খটকা লাগে।
জন্ম নিবন্ধন আর লাশ পাওয়া একই দিনে
মরিয়ম যখন মায়ের লাশ পাওয়া গেছে দাবি করছেন ময়মনসিংহে তার আগের দিন ২২ সেপ্টেম্বর মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম ফরিদপুরে জন্মনিবন্ধন সনদ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। বোয়ালমারী উপজেলার চেয়ারম্যান আবদুল হক বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর বেলা তিনটার দিকে রহিমা বেগম তার কাছে আসেন। এ সময় রহিমা বেগম তাকে বলেন, তার জন্ম ও শৈশব কেটেছে সৈয়দপুর গ্রামে। তবে পরবর্তী সময়ে ঘটনাচক্রে দীর্ঘদিন তাকে বাগেরহাট গিয়ে থাকতে হয়। সেখানে তিনি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতেন। এখন আবার জন্মভিটায় ফিরে এসেছেন। এসে দেখেন, ভাইয়েরা তাকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন। এ জন্য তার জন্মনিবন্ধন সনদ প্রয়োজন। একইসময়ে একদিকে শনাক্ত অযোগ্য লাশকে না দেখেই মায়ের লাশ মেনে নেওয়া এবং মা রহিমা বেগমের জন্মসনদের চেষ্টা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৩২ বছরের শুনেও কেন মা বলে দাবি করলেন?
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মেডিক্যাল অফিসার চিকিৎসক শোয়েব নাহিয়ান বলেন, ওই নারীর লাশটি অর্ধগলিত অবস্থায় ছিল। ওড়না পেঁচানো থাকায় গলায় দাগ ছিল। লাশ অর্ধগলিত থাকায় ধর্ষণের আলামত বোঝা যায়নি। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তার বয়স আনুমানিক ৩০-৩২ হবে বলে আমরা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারপরেও বারবার মরিয়ম দাবি করেছেন এটি তার মায়ের লাশ।
মা ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরলেন না কেন?
রহিমা বেগমকে উদ্ধারের ১৪ ঘণ্টা পরে তার মুখ থেকে জানা যায়, জমি নিয়ে বিরোধের জেরে তাকে অপহরণ করা হয়। অপহরণ মামলায় যাদের নাম রয়েছে তারাই মূলত অপহরণ করেছে বলে জবানবন্দি দেন তিনি। খুলনা পিবিআই পুলিশ সুপার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ‘রহিমা দাবি করেছেন অপহৃত হওয়ার কিছুদিন পর তার কাছ থেকে চারটি কাগজে স্ট্যাম্প নেন। এরপর এক হাজার টাকা তার হাতে দিয়ে মুকসুদপুরের বাসে তুলে দেওয়া হয়। তিনি মুকসুদপুর গিয়ে পরিচিতদের কাছে কয়েকদিন কাটান। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তিনি ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সৈয়দপুরে কুদ্দুসের বাড়ি ওঠেন। সেখানে তিনি অবস্থান করছিলেন। যখন যেখানে ছিলেন তখন সেখান থেকে পরিধেয় কাপড় পেয়েছেন।
কেন ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন না সেবিষয়ে জানতে চাইলে উত্তর মেলেনি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরো বিষয়টি কাছ থেকে পর্যবেক্ষণকারী এক স্বজন বলছেন, অপহরণের ঘটনা সত্য হতে পারে। মুক্তি পাওয়ার পরে তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্যও এমন কাজ করে থাকতে পারে।
রহিমা বেগমের পুত্রবধূ আর কল দিতে মানা করেছিলেন কেন?
বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামের যার বাড়িতে রহিমা বেগম আত্মগোপনে ছিলেন সেই কুদ্দুস বিশ্বাসের ভাগনে জয়নাল বলেন, মরিয়ম মান্নানের ফেসবুক স্ট্যাটাসে দেওয়া দুটি মোবাইল ফোন নম্বরেও (০১৭৭১১০..০২, ০১৫৫৮৩৪..০৫) যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। এর একটি নম্বরের কল রহিমা বেগমের ছেলে মিরাজের স্ত্রী রিসিভ করেন। জয়নাল বলেন, ‘রহিমার বিষয়টি তাকে বললে, তিনি ওই নম্বরে আর ফোন দিতে নিষেধ করেন। এরপর ফোন দিলেও আর ফোন রিসিভ করেননি।’
তিনি কেন এমন করলেন, প্রশ্নে মরিয়ম বলেন, ‘এই এক মাসে পোস্টার দেখে অনেকেই কল করেছে। অনেকেই খবর দেওয়ার জন্য টাকা চায়। যে যখন যেখানে ডেকেছে, শুনে শুনে চলে গিয়ে দেখেছি খবর সত্য না।’
খুলনা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পুলিশ সুপার মুসফিকুর রহমান বলেছেন, তাদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে এটা অপহরণের ঘটনা নাও হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। তার সঙ্গে ব্যাগ ছিল, ওষুধ ছিল, আই-ড্রপ ছিল, কাপড় ছিল। একজন অপহরণ হলে তার কাছ এসব জিনিস থাকার কথা না। প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এটা অপহরণ নাও হতে পারে। তবে অধিকতর তদন্তের জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
মরিয়মকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমি কখনও কারও বিচার চাই, ফাঁসি চাই বলি নাই। আমি বলেছি, আমার মাকে চাই। আমি মাকে পেয়ে গেছি। আমার কোনও প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা নাই।
প্রতিবেশীদের অভিযোগ
রহিমা বেগমের বাড়ির ভাড়াটিয়া মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, প্রতিবেশী কারও সাথে রহিমা ও তার পরিবারের সদস্যদের ভালো সম্পর্ক নেই। কথায় কথায় তারা লোকজনকে মামলা দেওয়ার হুমকি দেন। অপর ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম বলেন, ‘রহিমা বেগম নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা আতঙ্কের মধ্যে ছিলাম। পুলিশ এসে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। আমার ভাইকে পুলিশ ধরে নিয়ে দুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। রহিমাকে উদ্ধারের পর আমরা স্বস্তি পেয়েছি।’
রহিমা বেগমের নিখোঁজ মামলায় গ্রেফতার হয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে খুলনা কারাগারে রয়েছেন প্রতিবেশী মো. মহিউদ্দিন, তার ভাই গোলাম কিবরিয়া এবং আরেক প্রতিবেশী নূর আলম জুয়েল। গোলাম কিবরিয়ার স্ত্রী আয়েশা বলেন, ‘রহিমা বেগমের সতীনের কাছ থেকে তাদের বাড়ির ২ কাঠা জমি প্রথমে একজন মুহুরি কেনেন। সেই মুহুরির কাছ থেকে আমার স্বামী গোলাম কিবরিয়া ওই জমি কিনে নেন। এরপর থেকে রহিমা বেগম ও তার ছেলে-মেয়েরা আমাদের মিথ্যা মামলাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করে আসছে। তাদের হয়রানির শিকার প্রতিবেশী সকলেই। মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে বন্দি নূর আলম জুয়েলের স্ত্রী সুমি বেগম বলেন, ‘রহিমা বেগমকে অক্ষত উদ্ধার করা গেছে অথচ আমার স্বামী কারাগারে বন্দি। আমার এক ও দুই বছরের সন্তান তার বাবার জন্য কান্নাকাটি করছে।