সবুজ টিলাভূমির উপরে সাদা স্মারকস্তম্ভে লাল সূর্য। স্থাপত্যের বিষয়বস্তু- ‘চেতনায় আন্দোলিত ভূমি থেকে জেগে ওঠা বাঙালির আবহমান সংগ্রামী ঐতিহ্য’। এটাই সিলেটের কেন্দ্রীয় শহিদমিনার। দৃষ্টিনন্দন রূপের এই শহিদমিনার নজর কাড়ে সবার।
সিলেট নগরীর কেন্দ্রস্থলের জিন্দাবাজার-চৌহাট্টা সড়কের পাশে কেন্দ্রীয় শহিদমিনারটির অবস্থান ৩৩ শতক জায়গাজুড়ে। শহিদমিনারের পাশেই শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান।
২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে শহিদমিনারটি উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এটিকে দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শহিদমিনার বলে মন্তব্য করেছিলেন।
তবে এই শহিদমিনারটি সিলেটের আদি শহিদমিনার নয়। আগের শহিদমিনারটি ছিল ৮ শতক জায়গায়। এক পাশে ছিল শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। সেখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধযুদ্ধের সময় সদর হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে কর্তব্যরত অবস্থায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত চিকিৎসক শামসুদ্দিন আহমদসহ তাঁর সহকর্মীদের কবরস্থান। শহিদমিনার ও কবরস্থান আলাদাভাবে ছিল। আর অন্য পাশে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশের মতো সিলেটেও শুরু হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের সাথে যোগ দেন সিলেটের হাজারো মানুষ। ওই বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনার প্রাঙ্গণ ও এর সামনের সড়কে টানা অবস্থান করে আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন বিক্ষুব্ধ জনতা। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঘোষণা দেয়া হয়- ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে সিলেটে টানা অবস্থান আপাতত স্থগিত থাকবে।
আর সেই সুযোগটি কাজে লাগায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী অপশক্তি। ২২ ফেব্রুয়ারি দিনটি ছিল শুক্রবার। এদিন জুমার নামাজের পর ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে একটি মিছিল থেকে হামলা করা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে। ভাঙচুর করা হয় শহিদমিনার। এমনকি লোহার সীমানাপ্রাচীরও টেনে-হিঁচড়ে খুলে ফেলে হামলাকারীরা। এ ঘটনায় সিলেটসহ সারা দেশে নিন্দার ঝড় ওঠে।
এরপর তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেটে এসে ঘোষণা দেন ভাঙা শহিদমিনারের জায়গায় নির্মাণ করা হবে দৃষ্টিনন্দন শহিদমিনার। অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রায় ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন শহিদমিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক শুভজিৎ চৌধুরী শহীদ মিনারের নকশা আঁকার দায়িত্ব পান। তিনি বাঙালির সংগ্রামী চেতনাকে ধারণ করে এমন একটি নকশা এঁকে দেন।
নতুন শহিদমিনারের স্তম্ভগুলো কংক্রিট দিয়ে তৈরি করে এর ওপর বসানো হয়েছে শ্বেতপাথর। মাঝের স্তম্ভে বসানো হয়েছে রক্তিম সূর্য। মূল স্তম্ভের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তমঞ্চ ও মহড়াকক্ষ। এছাড়া রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। এখানে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই, স্মারক, স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা হয়।
শুভজিৎ চৌধুরী জানান, এই শহিদমিনারের নকশায় আন্দোলিত ভূমিকে মুখ্য বিষয় হিসেবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
নান্দনিক এই শহিদমিনার নির্মাণে সহযোগী স্থপতি হিসেবে কাজ করেছেন কৌশিক সাহা, সিপাউল রব চৌধুরী, ধীমান চন্দ্র বিশ্বাস ও জিষ্ণু কুমার দাস।