মুফতি হান্নানকে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন তারেক রহমান

‘আপনাদের এখানে আর আসার দরকার নাই। আপনারা বাবর সাহেব ও আবদুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন। তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে।’ বনানীর হাওয়া ভবনে পরপর দুই দিনের বৈঠকের শেষের দিন হুজিবির শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান ও তার সহযোগীদের এ কথা বলেছিলেন বিএনপির সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দিনটি ছিল ২০০৪ সালের ১৫ আগস্ট। এর তিন দিন পর ১৮ আগস্ট আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায় গ্রেনেড হস্তান্তর করা হয় মুফতি হান্নানের কাছে। সেই গ্রেনেড নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক হামলা চালানো হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের জনসভায়।

২০১১ সালের ৭ এপ্রিল ঢাকার মূখ্য অতিরিক্ত মহানগর হাকিম এএইচএম হাবিবুর রহমানের কাছে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন মুফতি হান্নান। যিনি নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি বাংলাদেশ- হুজিবি’র শীর্ষ নেতা।

২০০০ সালে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়ও শেখ হাসিনার জনসভায় বোমা পুঁতে রাখা হয়েছিল এই হান্নানের নেতৃত্বে। ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল অপর একটি মামলায় হান্নানের বিরুদ্ধে রায় হওয়া ফাঁসির দণ্ড কার্যকর করা হয়।

২০০৫ সালের ১ অক্টোবর মুফতি হান্নানকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান- র‌্যাব। গ্রেফতারের পর মুফতি হান্নান ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা স্বীকার করলেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের নির্দেশে তা চেপে যেতে বলা হয়। তখন মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি জজ মিয়ার কাহিনি বানানোর চেষ্টা করে।

২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর তদন্তে নতুন মোড় নেয়। ওই বছরেরই ১ নভেম্বর প্রথম দফায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন মুফতি হান্নান। তার সেই জবানবন্দি এবং মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। সেই অভিযোগপত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। অভিযুক্তদের সবাই ছিল হরকাতুল জিহাদের সদস্য।

২০০৯ সালের ৩ আগস্ট এই মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতের নির্দেশে সিআইডির পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ দুই বছর তদন্ত করে ২০১১ সালের ৩ জুলাই আদালতে আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তাতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ নেপথ্যের সকল কুশীলবের নাম উঠে আসে।

মামলার সেই তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ এখন অবসরে আছেন। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘এই মামলার অধিকতর তদন্ত করতে গিয়ে দেখেছি অনেক কিছুই বাদ পড়েছে। নেপথ্যের কুশীলব, হাওয়া ভবনে মিটিং— এসব আগের অভিযোগপত্রে ছিল না। মুফতি হান্নানও পুনরায় জবানবন্দিতে এসব বলেছেন। আমি হান্নানের জবানবন্দিসহ অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ যোগাড় করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছি। দীর্ঘদিন দুই পক্ষের জেরা শেষে বিচারক রায় দিয়েছেন।’

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মুফতি হান্নানের সম্পূরক জবানবন্দিই এই মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হান্নান আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছেন, ওই হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিএনপির কুমিল্লা এলাকার সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের মাধ্যমে জোট সরকারের প্রতিনিধি ও তারেক রহমানের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয় ও হাওয়া ভবনে বৈঠক হয়।

আদালতে দেওয়া সম্পূরক জবানবন্দিতে মুফতি হান্নান বলেছেন— ‘২০০৪ সালের প্রথম দিকে হুজির একটি মিটিং হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন আমির আবদুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ ও জান্দাল। মিটিংটি হয় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হুজির অফিস দারুল আরকান মাদ্রাসায়। মিটিংয়ে আবু বক্কর, মাওলানা ইয়াহিয়াও উপস্থিত ছিলেন। মিটিংয়ে কীভাবে তারেক রহমান ও বাবরের সঙ্গে কথা বলা যায় সে আলোচনা হয়। পরে মোহাম্মদপুর সাত মসজিদ রোডে মাওলানা আবদুস সালাম, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা তাজউদ্দিন, কাশ্মিরি নাগরিক আবদুল মাজেদ ভাটসহ একসঙ্গে পরামর্শ করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করি। মাওলানা তাজউদ্দিন গ্রেনেড সরবরাহ করার দায়িত্ব নেন। তাজ ভাই বলেন, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু ও প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর আমাদের সাহায্য করবেন বলে জানিয়েছেন।’

আদালতে দেওয়া মুফতি হান্নানের ভাষ্য, ‘একদিন মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদ সাহেব আমাদের হাওয়া ভবনে নিয়ে গিয়ে তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমরা আমাদের কাজকর্মের জন্য তাদের সহযোগিতা চাইলে তারেক রহমান সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এরপর আমরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরসহ আরও কয়েক জায়গায় গোপন মিটিং করি। …পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দিন, মাওলানা রশিদসহ আল মারকাজুলের গাড়িতে করে হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামের আলী আহসান মুজাহিদ, ব্রিগেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার, ব্রিগেডিয়ার আবদুর রহিমকেও উপস্থিত পাই। কিছুক্ষণ পর তারেক রহমান আসেন। আমরা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে তাদের সহায়তা চাই। তখন তারা আমাদের সকল প্রকার সহায়তার আশ্বাস দেন। তারেক সাহেব বলেন, আপনাদের এখানে আর আসার দরকার নাই। আপনারা বাবর সাহেব ও আবদুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন। তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে।’

মুফতি হান্নান বলেছেন, ‘১৮ আগস্ট আমি আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহেরকে নিয়ে আবদুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির সরকারি বাসায় যাই। সেখানে আবদুস সালাম পিন্টু, বাবর, মাওলানা তাজউদ্দিন, কমিশনার আরিফ ও হানিফ পরিবহনের হানিফ উপস্থিত ছিলেন। পিন্টু ও বাবর বলেন যে, কমিশনার আরিফ ও হানিফ সাহেব আপনাদের সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে এবং আমাদের সকল প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। সে মোতাবেক ২০ আগস্ট জান্দাল ও কাজল আবদুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে ১৫টি গ্রেনেড, ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করে বাড্ডার বাসায় নিয়ে আসেন। পরদিন ২১ আগস্ট আমরা পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলা চালাই।’

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত ও কয়েক শ’ মানুষ আহত হন। এই মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যাল-১ এই মামলার রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনের ফাঁসির দণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়।