সিলেটের কানাইঘাটে নিখোঁজ শিশু মুনতাহা আক্তার জেরিনের সন্ধান ও উদ্ধারের আশা যখন সারাদেশের মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন তাকে ফিরে পেতে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাড়ির পাশ থেকেই সাড়ে ৫ বছরের ফুটফুটে শিশু মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
রোববার (১০ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাড়ির পার্শ্ববর্তী খালে পুতে রাখা মুনতাহার লাশ উঠিয়ে প্রতিবেশির পুকুরে ফেলার চেষ্টাকালে গলায় রশি পেঁচানো মুনতাহার লাশ উদ্ধার সহ ঘটনার সাথে জড়িত আলিফজান বিবিকে আটক করা হয়।
মুনতাহার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধারের সংবাদ পেয়ে কানাইঘাট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশ উদ্ধার সহ একই বাড়ির মৃত ময়না মিয়ার স্ত্রী আলিফজান বেগম (৫৪), বৃদ্ধ কুতুবজান বেগম (৭০) কে পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে আসে। এলাকার বিক্ষুব্ধ লোকজন মুনতাহার লাশ পাওয়ার পর হত্যাকারী আলিফজান বিবি’র বসত ঘরটি ভেঙে ঘুড়িয়ে দেয়।
এর আগে থানা পুলিশ শনিবার গভীর রাতে আলিফজান বিবি’র মেয়ে নিখোঁজ মুনতাহার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী শামীমা বেগম মার্জিয়াকে আটক করে পুলিশ। মার্জিয়াকে থানা পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসার পর পুলিশের ভয়ে আলিফজান বিবি বসত ঘরের পাশে একটি নর্দমায় পুতে রাখা নিখোঁজ মুনতাহার লাশ তুলে রাত সাড়ে ৩টার দিকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের পুকুরে ফেলার চেষ্টার সময় আব্দুল ওয়াহিদ সহ আরো কয়েকজন হাতে নাতে আলিফজান বিবিকে আটক করেন।
কানাইঘাট থানা পুলিশ এখন পর্যন্ত কানাইঘাট সদর ইউনিয়নের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শিশু মুনতাহার হত্যাকারী শামীমা বেগম মার্জিয়া (২৫), তার মা আলিফজান বিবি (৫৫), মৃত ছইদুর রহমানের পুত্র ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুনুর রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩৫) কে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা প্রত্যক্ভাবে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত রয়েছেন বলে থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল আওয়াল জানিয়েছেন।
জানা যায়, গত ৩ নভেম্বর দুপুরবেলা শিশু মুনতাহা জেরিন তার বাড়ি থেকে পার্শ্ববর্তী আব্দুল ওয়াহিদের বাড়ির শিশুদের সাথে খেলতে যায়। ঐদিন বিকেল পর্যন্ত শিশু মুনতাহা বাড়িতে ফিরে না আসলে তাকে খোঁজাখুজি করে না পেয়ে পিতা শামীম আহমদ কানাইঘাট থানায় মেয়ে নিখোঁজের জিডি করেন। মুনতাহা নিখোঁজের পর থেকে থানা পুলিশ সহ অন্যান্য আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং তার আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার সবাই সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজাখুজি করেও নিখোঁজ মুনতাহার কোন সন্ধান পাননি। ফুটফুটে সুন্দর শিশু মুনতাহা নিখোঁজের সংবাদ গণমাধ্যম সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সারাদেশের মানুষ নিখোঁজ মুনতাহাকে ফিরে পেতে ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দেন এবং অনেকে স্বইচ্ছায় খোঁজাখুজি করতে থাকেন। সবার অপেক্ষা ছিলো নিখোঁজ মুনতাহার সন্ধান পাওয়া যাবে এবং সে জীবিত অবস্থায় তার বাবা-মা’র কোলে ফিরে আসবে। সেই সূত্র ধরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ফিরে পেতে সন্দেহজনক ব্যক্তিদের ডাটাবেজ ধরে প্রযুক্তির আশ্রয় নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিখোঁজের একসপ্তাহ পর নিজ বসত বাড়ির আলিফজান বিবি’র বসত ঘরের পাশে নর্দমায় পুতে রাখা মুনতাহার অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ জানান, শিশু মুনতাহার এক সময়ের গৃহ শিক্ষিকা ছিল আলিফজান বিবির মেয়ে শামীমা আক্তার মার্জিয়া। কিন্তু মার্জিয়ার খারাপ আচরণের কারণে মুনতাহার পিতা শামীম আহমদ তার মেয়ে মুনতাহাকে পড়াতে নিষেধ করেন। এতে প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে উঠে মার্জিয়া। মুনতাহার বাবা-মা’র উপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য গত ৩ নভেম্বর নিখোঁজের দিন মুনতাহাকে কৌশলে মার্জিয়া এবং তার মা আলিফজান বিবি তাদের বসত ঘরে নিয়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার পর মুনতাহার মুখের মধ্যে ওড়না ঢুকিয়ে এবং গলায় রশি প্যাঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে লাশ বস্তাবন্দী করে ঘরের মধ্যে রাখে হত্যাকারীরা। এরপর গভীর রাতে হত্যাকারীরা মুনতাহার লাশ পলিথিনে মুড়িয়ে বসত ঘরের পাশে খালের নর্দমায় পুতে রাখে। একাধিকবার মুনতাহার পরিবারের লোকজন মার্জিয়া সহ তার পরিবারের কাছে মুনতাহা নিখোঁজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে একেক সময় একেক ধরনের কথা বলতে থাকেন তারা। মার্জিয়ার পরিবারের লোকজনের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সন্দেহ হলে গত শনিবার রাতে থানা পুলিশ মার্জিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসা হয়। মার্জিয়াকে থানায় নিয়ে আসার পর তার মা আলিফজান বিবি নিহত মুনতাহার পুতে রাখা লাশ তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী বাড়ির পুকরে ফেলার চেষ্টাকালে আলিফজান বিবিকে হাতেনাতে আটক করেন স্থানীয়রা।
তাৎক্ষণিক থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আলিফজান বিবি তার মা কুতুবজান বিবিকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। আটক আলিফজান বিবি ও তার মেয়ে শামিমা বেগম মার্জিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকান্ডের স্থানীয় বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামেরমৃত ছইদুর রহমানের ছেলে ইসলাম উদ্দিন (৪০) ও মামুন রশিদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) কে গতকাল রবিবার দুপুরে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত ৪ জনকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে।
শিশু মুনতাহাকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত আলিফজান, মার্জিয়া, ইসলাম উদ্দিন ও নাজমা বেগমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে থানার ওসি আব্দুল আউয়াল জানিয়েছেন।
এদিকে রবিবার বিকেল ২টার দিকে সিলেটের পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান নিহত মুনতাহার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের লোকজনকে শান্তনা প্রদান এবং হত্যাকান্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তিনি এলাকার অনেকের সাথে কথা বলেন। স্থানীয় লোকজন হত্যাকারীদের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবী জানান তার কাছে।
এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান জানান, শিশু মুনতাহাকে উদ্ধার করে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ সর্ব্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। মুনতাহার হত্যাকারী ৪ জনকে ইতিমধ্যে আমরা গ্রেপ্তার করেছি এবং এ হত্যাকাণ্ডের সাথে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদের প্রত্যেককে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানান।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে পুলিশ সুপারের সাথে ছিলেন, সিলেট জেলার এডিশনাল পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম, কানাইঘাট সার্কেলের এএসপি অলক কান্তি শর্মা, থানার ওসি আব্দুল আউয়াল।
এদিকে শিশু মুনতাহার লাশ ময়না তদন্তে শেষে বাড়িতে নিয়ে আসলে সেখানে আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। উপস্থিত এলাকার শত শত লোকজন মুনতাহা হত্যাকান্ডের ঘাতকদের ফাঁসির দাবী জানান। রোববার বিকেলে মুনতাহার লাশ বীরদল পুরানফৌদ জামে মসজিদে জানাজা শেষে গ্রামের পঞ্চায়েত কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।