দেশে করোনা সংক্রমণের বিস্তার আবারও বেড়ে চলেছে। যদিও বেশ কিছু দিন তা নিম্নমুখী থাকায় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের কথা ভুলতে বসেছে সাধারণ মানুষ। হাট-বাজার, দোকান, শপিং মল সব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অনীহা থেকে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, মানুষ একদমই মাস্ক পরে না। করোনা শনাক্তের হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক টেকনিক্যাল কমিটি যেসব পরামর্শ দিয়েছে, তার মধ্যে আছে— স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য জনসাধারণকে পুনরায় উদ্বুদ্ধ করতে সব ধরনের গণমাধ্যমে অনুরোধ জানাতে হবে। সব ক্ষেত্রে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা, ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি প্রয়োগ করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগম বর্জন করা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত জানুয়ারিতে করোনা আক্রান্তের হার ছিল একদিনে সর্বোচ্চ ৩৩ শতাংশ। সেদিন শনাক্ত হয়েছিল ১৫ হাজার ৪৪০ জন। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটেও একদিনে এত রোগী পাওয়া যায়নি। এরপর শনাক্তের হার ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে ফেব্রুয়ারিতে। মার্চ থেকে জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। এরপর থেকে আবারও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। ৬ জুন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১ শতাংশের নিচে থাকলেও ৭ জুন থেকে ১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আড়াই মাস পর ১২ জুন আবারও একদিনে শতাধিক শনাক্ত হয়। ৭ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত ৯ দিনে শনাক্ত হয় ৮৮৩ জন। এরমধ্যে ১৫ জুন একদিনে দুই শতাধিক শনাক্ত হয়। এরপর শনাক্ত আরও বেড়ে সোমবার (২০ জুন) শনাক্তের হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। সোমবার শনাক্ত হয়েছেন ৮৭৩ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম প্রধান বাহন হলো শ্বাসনালি থেকে বেরিয়ে আসা ক্ষুদ্র জলকণা (ড্রপলেট), যা কথা বলা, গান গাওয়া, কাঁশি বা হাঁচি দেওয়ার সময় বেরিয়ে আসে। যদিও গবেষণা চলমান রয়েছে, তবে আমরা এখন জানি যে ভাইরাস এমন মানুষের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে, যাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার কোনও লক্ষণ নেই। এর অর্থ হচ্ছে, কিছু মানুষ সংক্রমিত হতে পারে, এমনকি কোনও ধরনের উপসর্গ ছাড়াই। যেসব জায়গায় কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব বেশি– সেসব স্থানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তবে জনাকীর্ণ স্থানগুলোতে অন্যদের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখা সবসময় সম্ভব নয়, যে কারণে এই ধরনের পরিস্থিতিতে সবাইকে সুরক্ষিত থাকার জন্য কাপড়ের তৈরি মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ওমিক্রন প্রতিরোধে মাস্ক ব্যবহারের ওপরে গুরুত্বারোপ করেছে। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে মাস্কের কার্যকারিতা বিষয়ে যথাযথ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় গবেষণাটি হয় বাংলাদেশে, যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। গবেষকরা ৬০০টি গ্রামে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষকে বিনামূল্যে সার্জিক্যাল ও কাপড়ের মাস্ক বিতরণ করে এবং বিভিন্নভাবে মাস্কের সঠিক ব্যবহার ও উপকারিতা জানায়। ২০২১-এ এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। ইউরোপে করা প্রায় একই ধরনের আরেকটি গবেষণার তথ্যও প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে।
দুটি গবেষণাতেই দেখা যায়, সবাই যদি যথাযথভাবে মাস্ক ব্যবহার করে, তবে কোভিড সংক্রমণের হার ৫৩ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা সম্ভব। ব্যাংকক শহরে অন্য একটি গবেষণায় দেখা যায়, কোভিড-১৯ আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকার সময় মাস্কের যথাযথ ব্যবহার সংক্রমণের ঝুঁকি প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনে। মাস্কের সর্বোচ্চ কার্যকারিতা তখনই নিশ্চিত করা যায়, যখন এটি সবাই সঠিক নিয়মে পরবে বলে উল্লেখ করা হয় ওই গবেষণায়।
মাস্ক পরতে সমস্যা নেই, তবে অনেক সময় অস্বস্তি লাগে বলে জানান একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হাবীব আহমেদ। তিনি বলেন, ‘সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরা দরকার, তবে অনেক সময় অস্বস্তি লাগে। এই বিষয়ে করণীয় কী?’
মাস্ক পরলে অনেকেরই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমার মতো শারীরিক সমস্যার কারণে এই অস্বস্তি লাগতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাদের ক্ষেত্রে মাস্ক পরাটা জরুরি না। তবে এই সমস্যাটা বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই মানসিক। কানাডার মনস্তাত্ত্বিক রোগ বিষয়ক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সিবিটি অ্যাসোসিয়েটসের মতে, এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যেতে পারে শ্বাস-প্রশ্বাসের একটি ব্যায়াম যা ‘বক্স ব্রেথিং’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ায় ১-৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে শ্বাস নিন, ৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে দম ধরে রাখুন, ৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে শ্বাস ছাড়ুন এবং ৪ পর্যন্ত গুনতে গুনতে আবার শ্বাস নিন। অর্থাৎ ধীরগতিতে শ্বাস নিন, কয়েক সেকেন্ড শ্বাস ধরে রেখে আবার ধীরগতিতে ছাড়ুন। এতে আপনার স্নায়ু শান্ত হবে, শ্বাসতন্ত্রের উপকার হবে এবং মাস্ক পরে শ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগের অভ্যাস হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর পুনরায় মাস্ক পরার বিষয়ে প্রচার প্রচারণা শুরু করবে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত একবার হোক কিংবা একাধিকবার হোক, ওমিক্রন হোক কিংবা ডেল্টাই হোক, ভ্যারিয়েন্ট যদি একবার প্রবেশ করে তাহলে মানুষ আক্রান্ত হবে। টিকা নেওয়া থাকলে রোগের তীব্রতা কম হবে, কিন্তু আক্রান্ত হবেন না এটা ঠিক না। মাস্ক না থাকলেও শুধু টিকা নেওয়া থাকলে যে আক্রান্ত হবে না, এটা ভুল কথা। সুতরাং, মাস্ক অবশ্যই পরা জরুরি। এখন যে ঢেউ শুরু হয়েছে তাতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, যদি না ভাইরাসটিকে শরীরে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া না হয়।’