আজ মঙ্গলবার (২৭ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব পর্যটন দিবস। এ দিবসে হবিগঞ্জ শহরের টাউন হল থেকে সাইকেল শোভাযাত্রায় বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণকারী রামনাথ বিশ্বাসকে স্মরণ করা হয়।
শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান। এর আয়োজন করে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটি। ওই কমিটির পক্ষে পর্যটন দিবসের প্রতীকী কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রামনাথের বাড়িটি পুনরুদ্ধারের পর সেখানে ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের একটি বিশেষায়িত পাঠাগার এবং বাইসাইকেল মিউজিয়াম গড়ে তোলার দাবি জানানোর হয়।
দুপুরে বানিয়াচং শহীদ মিনারে বানিয়াচংয়ের সন্তান খ্যাতিমান সাংবাদিক দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু প্রতীকী অনশন। বাইসাইকেল শোভাযাত্রা রামনাথের বাড়ি বিদ্যাভূষণ পাড়া ঘুরে এসে বিষ্ণুর অনশন ভঙ্গ করানো হয়। পরে বানিয়াচং শহীদ মিনারে সমাবেশের মধ্য দিয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। এ শোভাযাত্রায় দেশের বিভিন্ন স্থানের লোকজন অংশগ্রহণ করেন।
জানা গেছে, ভারতের কলকাতায় রয়েছে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস সড়ক। অথচ নিজভূমে তিনি হয়ে গেছেন পরবাসী। রামনাথের স্মৃতিবিজড়িত হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে বিদ্যাভূষণ পাড়ার বাড়িটির দখলদার আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া আল-বদর পরিবারের সদস্য। নিজেও এক সময় জামায়াত-বিএনপি করতেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে রীতি মতো ওয়ার্ড কমিটির সভাপতির পদও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। দলীয় পরিচয়ের জোরে রামনাথের বাড়ি দেখতে যাওয়া পর্যটক, বাইসাইকেল রাইডার ও সাংবাদিকের ওপর বিভিন্ন সময় হামলা চালিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ থেকে ওয়াহেদ বহিষ্কৃত হয়েছেন। তবে শুধু দল থেকে বহিষ্কার করা বড় কোনো সমাধান নয়। রামনাথ বিশ্বাসের বসতবাড়িটি এই দখলদারের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ওই বাড়ির প্রায় পাঁচ একর জমির সবটুকুই এখন সরকারি খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা। প্রকৃতপক্ষে সরকারই এ জমির মালিক। তাই বিস্মৃতপ্রায় ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের স্মৃতি রক্ষার দায়িত্বও সরকারের।
ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটা পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক রুমা মোদক বলেন, যারা হবিগঞ্জের মানুষ, তাদের কাছে ভূপর্যটক রামনাথ বিশ্বাসকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। আমাদের মধ্যে যাদের তার বই পড়া হয়নি, তারাও জানি রামনাথ আমাদের গর্বের ধন। তিনি আমাদের হবিগঞ্জের তো বটেই, গোটা বাংলার গর্ব।
শতেক বছর আগে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ার রামনাথ বিশ্বাস বাইসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলেন ভূ-পর্যটনে। দেশে দেশে ভ্রমণ করেই ক্ষ্যান্ত হননি তিনি, বাঙালির ঘরকুনো অপবাদ ঘুচানো এই মানুষটি লিখেছেন ভ্রমণবিষয়ক গোটা চল্লিশেক বই।
উদার-অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী রামনাথের জন্ম ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি। বানিয়াচংয়ের লোকজন এখনও তাদের গ্রামগুলোকে পাড়া বলে ডাকেন। ইউনিয়নগুলো নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেন। পুরো বানিয়াচং একটা গ্রাম, সেই দাবির যৌক্তিকতা ধরে রাখার জন্যই এমনটা করেন বলে আমাদের ধারণা, যে ধারণার জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন রামনাথ বিশ্বাস। তিনি দাবি করেছিলেন, বানিয়াচং পৃথিবীর বৃহত্তম গ্রাম।
বানিয়াচংয়ের হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন রামনাথ। এরপর তার বাবা বিরজানাথ বিশ্বাসের মৃত্যু হলে পড়াশোনার ইতি ঘটে। মা গুণময়ী দেবীরও অকাল মৃত্যু হয়েছিল। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে রামনাথ হবিগঞ্জে ভান্ডার সমিতি বলে একটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার পদে যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। এখানে তিনি বাইসাইকেল ও মোটর গাড়ি চালানো শিখেছিলেন।
ওই সময় তিনি অনুশীলন সমিতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের সঙ্গে তার যোগ প্রকাশ হয়ে গেলে চাকরি হারান। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে বাঙালি পল্টনের সঙ্গে চলে যান মেসোপটেমিয়ায়। সেটা ১৯১৪ সালের কথা। সৈনিক জীবনে ঘুরে বেড়াবার যে সুযোগ পেয়েছিলেন সেই অনুপ্রেরণায় ১৯৩১ সালের একদিন সাইকেল নিয়ে পথে নামেন রামনাথ বিশ্বাস। তখন তিনি সিঙ্গাপুরে চাকরি করেন, যে দেশে গিয়েছিলেন ১৯২৪ সালের শেষের দিকে।
রামনাথের জীবনীকার শ্যামসুন্দর বসুর লেখা থেকে জানা যায়, সঙ্গে এক জোড়া চটি, দুটি চাদর নিয়েছিলেন। বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে একটি বাক্সে ছিল সাইকেল মেরামতের সরঞ্জাম। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রিট থেকে যখন যাত্রা শুরু করেন, তখন সেখানকার বাঙালি মসজিদের সামনে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপচে পড়েছিল তাকে বিদায় জানাতে।সমবেতজনের বেশিরভাগই ছিলেন সিলেটি। রামনাথ হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে ভালোবাসতেন।
কুইন স্ট্রিট থেকে সেবার রামনাথ সাইকেলে করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান হয়ে কানাডায় পৌঁছান। কানাডায় তাকে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২৯ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতা হয়ে ১৯৩৪ সালে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। সেবার বানিয়াচংয়ের সাগরদীঘির পাড়ের মাঠে, মতান্তরে সাগরদীঘি পাড়ের অদূরে এড়ালিয়া মাঠে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল, সেই সভার গল্প ঘুরে ফিরে শুনতে পাবেন বানিয়াচংয়ের লোকজনের কাছে।
১৯৩৪ সালে রামনাথ দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন। সেবার তিনি আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে ব্রিটেন পৌঁছান। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডও তিনি সাইকেলে পরিভ্রমণ করেন।
সেই যাত্রায় তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে লন্ডন থেকে জাহাজে মুম্বাই ফিরে আসেন। সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে। ততদিনে রামনাথের লেখা ছাপা হচ্ছে ‘দেশ’ সাময়িকীতেও। কবিগুরু তাঁর ভ্রমণকাহিনি পড়েছেন এ কথা জেনে খুবই আপ্লুত হয়েছিলেন রামনাথ।
তৃতীয়বারের যাত্রা শুরু করেন ১৯৩৮ সালে। সেবার রামনাথ বিশ্বাস আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। মুম্বাই থেকে তিনি জাহাজে মোম্বাসায় পৌঁছে সেখান থেকে সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ঘুরে গিয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভালো লাগেনি বলে লিখেছিলেন। ১৯৪০ সালে দেশে ফিরে চলে আসেন বানিয়াচংয়ে। ততদিনে ভ্রমণ সাহিত্য রচনায় তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলায়।
কলকাতা আর বানিয়াচংয়ে যাতায়াতের মধ্যে থাকলেও রামনাথ বিশ্বাস নিজ ভিটা বানিয়াচংয়ে স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর পুরোপুরি কলকাতায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানেই ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর মারা যান।