প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও তা ঘিরে নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞায় গোটা বিশ্বের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেছেন, গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম।
এসব সংকট কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা সম্ভব নয় উল্লেখ করে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বৈশ্বিক সংহতির ওপর জোর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংকট সমাধানে পাঁচ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেছেন তিনি।
বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থবিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের তৈরি প্লাটফর্ম ‘চ্যাম্পিয়নস গ্রুপ অফ গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স’ (জিসিআরজি) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বুধবার সকালে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অ্যান্তোনিও গুতেরেস এতে সভাপতিত্ব করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটগুলো আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিতে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। এটি কোভিড সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রচেষ্টা এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের পথে যোগ করেছে নতুন চ্যালেঞ্জ।’
চলমান এই বিপর্যয়ের একটি গ্রহণযোগ্য সমাপ্তি টানতে উপায় খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা গোটা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে যুদ্ধরত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।’
সংকট মোকাবিলায় জাতিসংঘ তার নিজস্ব ব্যবস্থাকে সক্রিয় করায় সংস্থার মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এই সংকট কাটিয়ে উঠতে সঠিক নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এ জন্য অন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতেও আমরা প্রস্তুত।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশে আমরা সুনির্দিষ্ট আর্থিক ব্যবস্থা অনুসরণ করছি। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বহু গুণে প্রসারিত করা হয়েছে। কৃষি, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প এবং অন্য দুর্বল খাতগুলো রক্ষায় সহায়তা দেয়া হচ্ছে। জ্বালানি খাতে নবায়নযোগ্য অংশ বাড়াতে নেয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
‘কিন্তু চলমান এই সংকট এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে মোকাবিলা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং বৈশ্বিক সংহতি।’ সংকট মোকাবিলায় পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করেন সরকারপ্রধান।
প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার দিকে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। জি-৭, জি-২০, ওইসিডি, আইএফআই ও এমডিবির মতো সংস্থাগুলোকে সংকট সমাধানে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সংকটগুলোর মধ্যে রয়েছে- এসডিজিতে অর্থায়নের অভাব, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও ওডিএ কমে আসা এবং ঋণ পরিষেবা।’
দ্বিতীয় প্রস্তাবের শুরুতে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন’ উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় জাতিসংঘ মহাসচিবের প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধ-সংঘাতের সময় খাদ্য উৎপাদন ও বিতরণ ব্যবস্থা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো উদ্যোগ সমর্থনে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি।’
শেখ হাসিনা তৃতীয় প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, ‘বৈশ্বিক বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করতে আমাদের সাহসী ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। বিশ্ব বাণিজ্য ও রপ্তানি আয়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ন্যায্য অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।’
চতুর্থ প্রস্তাবে উৎপাদনশীলতা এবং কার্যকর খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন বাংলাদেশের টানা তিন মেয়াদের প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি, প্রযুক্তি সহায়তা, ওডিএ উন্নত করা এবং রেয়াতি অর্থায়নে সরকার থেকে সরকার (জিটুজি) এবং বাণিজ্য থেকে বাণিজ্য (বিটুবি) খাতে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’
পঞ্চম প্রস্তাবে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আমাদের জলবায়ু সহযোগিতায় বিশ্ব স্থাপত্যকে আরও কার্যকর ও ন্যায়সংগত করতে হবে। আমাদের উচিত আসন্ন কপ-২৭-এর সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর উদ্বেগ মোকাবিলায় সহযোগিতা করা। আমরা আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে মিলে জ্বালানি নিরাপত্তায় কাজ করতে ইচ্ছুক।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই উদ্যোগের ফলে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি শিগগিরই একটি পারস্পরিক সমাধান বেরিয়ে আসবে।’
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো, খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তা এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জিসিআরজি গঠনে এগিয়ে আসে জাতিসংঘ।
এই গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য, যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বের দরিদ্র ও ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেয়া। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা এই গ্রুপে যোগ দিতে সম্মত হয়েছেন।
২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জিসিআরজি গঠনের কথা জানান অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এ বছরের ১৩ এপ্রিল জিসিআরজিতে যুক্ত হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন দিয়ে আহ্বান জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হতে সম্মতি জানান প্রধানমন্ত্রী।