আদিবাসী ‘মণিপুরি’ পরিবারে বৃন্দারাণী’র জন্ম। পুরো নাম বৃন্দারাণী সিনহা। পেশায় তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। চাকরি করেই উজ্জ্বল দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। তবে তিনি শিকড় থেকে দূরে যেতে পারেননি। ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা মণিপুরি জনগোষ্ঠীর ভাষা ‘ইমালোন’ মাতৃভাষার প্রতি বৃন্দারানী’র হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। বাংলাদেশে মণিপুরি ভাষার প্রায়োগিক ক্ষেত্র যেমন নেই, তেমনি নেই এর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ না থাকার ফলে ‘কালের বিবর্তনে মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভাষা ও সংস্কৃতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাই নিজের ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে চাকরির পাশাপাশি তিনি ‘মণিপুরি বর্ণমালা’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন মাতৃভাষা ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে।
বৃন্দারানী’র সাথে আলাপে কথায় কথায় জানা গেল চাকরির পাশাপাশি মণিপুরি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন তিনি। ‘মণিপুরি ভাষার বর্নমালা রক্ষায় ব্যাক্তিগত উদ্যোগে নতুন প্রজন্মের কাছে তাদের ভাষাটি যেন তুলে দেয়া যায় সেই চিন্তা থেকেই মণিপুরি পল্লীতে ‘মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেন৷
বৃন্দারাণী সিনহা জানালেন, তাঁর স্বামী সুখময় সিংহের সঙ্গে আলোচনা করে ২০১৯ সালে ২৩ আগস্ট মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর ইউনিয়নে হকতিয়ারখোলায় নিজ বাড়িতে এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এটি পরিচালনা করে আসছেন তিন বছর ধরে। এখানে মণিপুরি শিশুরা তাদের নিজস্ব বর্ণমালায় পড়তে ও লিখতে পারায়, মণিপুরি শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির মূল স্রোতোধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টায় মণিপুরি ভাষাচর্চায় নতুন প্রাণ ফিরেছে। বর্তমানে বৃন্দারাণী তাঁর এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মোট পঁয়ত্রিশ(৩৫) জন নিয়মিত শিক্ষার্থী রয়েছে এবং নানা বয়সের ২১(একুশ) জন মহিলাকেও পাঠদান করে থাকেন। এই স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে মণিপুরি বর্নমালা শেখার। নতুন দুয়ার খুলেছে গবেষণারও।
বৃন্দারাণী’র পৈতৃক নিবাস কমলগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের ভান্ডারী গাঁও গ্রামে। ১৯৬৪ সালের ৬ই জুলাই বৃন্দা রানী সিনহা চন্দ্রকান্ত সিংহ ও কন্যা তম্বী দম্পতি সনাতন ধর্মাবলম্বী মণিপুরি পরিবারে জন্মগ্রহণ গ্রহণ করেন৷ ১৯৮৪ সালে শিক্ষকতা দিয়েই কর্মজীবন শুরু করেন ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পরে তিনি বদলি হয়ে বর্তমানে হকতিয়ারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। কর্মময় জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর মণিপুরি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কমলগঞ্জ এর পক্ষ থেকে গর্বিত মা হিসেবে সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদের সভাপতি কবি এ কে শেরাম জানান, বাংলাদেশে মণিপুরি ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ২০১২ সালে প্রথম শুরু করেন মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা৷ পর্যায়ক্রমে এই সংগঠন কমলগঞ্জে ৩টি এবং সিলেট, ছোটধামাই, শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জের বিশগাঁয়ে ১টি করে মোট ৭ টি অনিয়মিত স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে ভাষা ও লিপি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু ক্রমশ এইসব ভাষা-স্কুলগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। বৃন্দা রানী সিনহা’র মণিপুরী ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গত কয়েকদিন আগে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মণিপুরী লিপি ও ভাষা শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিদর্শন করে এ কে শেরাম বলেন, বৃন্দা রানী সিনহা অত্যন্ত সফলতার সাথে এখনও এই কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনা করছেন। তাঁর এই আন্তরিক কার্যক্রম, আত্মত্যাগী মনোভাব এবং মাতৃভাষার প্রতি ঐকান্তিক ভালোবাসা সত্যিই অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি তার এই মহান ব্রতে আরও সফলতা অর্জন কামনা করেন।
শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা খুবই উৎফুল থাকে মাতৃভাষা শিক্ষার ক্লাসে। মাতৃভাষার কারণে তাদের পড়াশোনা আগ্রহ বাড়ে। বাংলা ভাষার চেয়ে মাতৃভাষা শিক্ষায় আগ্রহ তাদের বেশি। মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শিক্ষার্থী সানাহেন সিংহ (অয়ন) এর মা অরুনা রানী সিনহা জানান, তিনি তার ছেলের কাছ থেকেই ভাষা শেখেন। নিজের ভাষায় পড়তে খুবই ভালো লাগে তার। ভাষা শিক্ষা প্রসঙ্গে শিক্ষিকা বৃন্দারাণী সিনহা তার দাবী মণিপুরি ভাষা শিক্ষার এ কার্যক্রমের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হলে সরকারিভাবে মণিপুরি ভাষাকে জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
মণিপুরি মুসলিমদের কবি ও সংগঠক রওশন আরা বাঁশি খূৎহৈবম মণিপুরি ভাষা স্কুল পরিদর্শন করে বলেন, পাঠদান প্রক্রিয়া অত্যন্ত চমৎকার এবং আন্তরিকতার ছাপ লক্ষ্যনীয়। শিক্ষিকা বৃন্দা রাণী সিনহার একক প্রচেষ্টায় শিক্ষার্থীরা মণিপুরি বর্ণমালার সাথে পরিচিত হচ্ছে এবং মাতৃভাষা শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, বৃন্দা রাণী সিনহা আমাদের গর্ব আমাদের অহংকার। তাঁর এই মহৎ উদ্যোগকে স্বাগত জানায়।
বাংলাদেশ মণিপুরি মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্টের সভাপতি লেখক ও গবেষক সাজ্জাদুল হক স্বপন জানান,‘‘শিক্ষালাভের সুযোগ কিংবা ব্যবহারিক উপযোগীতা না থাকলেও এতদিন ‘পারিবারিক ভাষা’ হিসেবে ঘরে নিজেদের ভাষাতেই কথা বলতেন মণিপুরিরা। কিন্তু ইদানীং নারী শিক্ষিকা বৃন্দারাণী সিনহা’র উদ্যাগে মণিপুরি শিশু-কিশোররা এখন নিজেদের মাতৃভাষার বর্নমালাতে লিখতে ও পড়তে পারেন। তিনি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতির অঙ্গীকার পূরণের লক্ষে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দ্রুত মণিপুরিসহ অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর শিশুদের নিজ নিজ ভাষায় পাঠদান চালু করা জরুরি।
শিক্ষকতা আর মাতৃভাষায় পাঠদানের পাশাপাশি মণিপুরি সমাজে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন বৃন্দারাণী। মণিপুরি ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হাওয়ার পিছনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এই সংগঠনের মাধ্যমে মণিপুরি সম্প্রদায়ের মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করা হয়। এই শিক্ষিকা মণিপুরি ভাষা আর মণিপুরি সম্প্রদায়কে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেন। তিনি জানালেন, শত ব্যস্ততা থাকলেও তিনি মণিপুরি ভাষাচর্চা চালিয়ে নিতে চান। আর মণিপুরি সম্প্রদায়ের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চান বিশ্বমঞ্চে। যেন মণিপুরি সম্প্রদায়ের সদস্যরা বুক ফুলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে পারেন।