সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে গত চার বছরে হরিণ ও শূকর বেড়েছে। যা খাবার হিসেবে গ্রহণ করে বাঘ। ফলে সুন্দরবনে বাঘের খাদ্য সংকট নেই। এখন আর বাঘ লোকালয়েও যায় না। এজন্য খাদ্যাভাবে বাংলাদেশের বাঘ ভারতে যাওয়ার তথ্য সঠিক নয়। আর বাংলাদেশের বাঘ ভারতে যাওয়ার কোনও নজির নেই। তবে ভারতের দুটি বাঘ বাংলাদেশে আসার রেকর্ড আছে। বাঘের একটা নির্দিষ্ট টেরিটোরি আছে। আহত বা পরাস্ত না হলে এই টেরিটোরির বাইরে যায় না বাঘ।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছেন ‘খাদ্যাভাবে’ বাংলাদেশের বাঘ ভারতে গেছে। তার এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করে বাংলা ট্রিবিউনকে এসব তথ্য জানিয়েছেন সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. আবু নাসের মহসিন।
তিনি বলেছেন, ‘রায়মঙ্গল নদীর এপার-ওপারে বাঘের আসা যাওয়া আছে। ২০১৮ সালের পর গত চার বছরে সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের সংখ্যা বেড়েছে। কারণ সুন্দরবন জলদস্যু মুক্ত হয়েছে। আর রাসমেলা বন্ধ থাকায় হরিণ শিকার বন্ধ হয়েছে। প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে নভেম্বর থেকে বাঘ জরিপ শুরু হবে। এবার ৩০০টি ক্যামেরা দিয়ে বাঘ গণনার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’
আবু নাসের মহসিন বলেন, ‘কেউ যদি বাঘের বিজ্ঞান বোঝে, বাঘের ইকোলজি বোঝে, বিহেভিয়ার বোঝে, তাহলে প্রত্যেকটি বাঘের টেরিটোরি বুঝবে। কটকার বাঘের একটা নির্দিষ্ট টেরিটোরি আছে। যা প্রত্যেকটি এলাকার বাঘের রয়েছে। সে নিজের নির্দিষ্ট এলাকা অতিক্রম করে অন্য এলাকায় যাবে না। যদি সে পরাস্ত কিংবা আহত না হয়। সুন্দরবনের কটকায় যে বাঘটা আছে সে কোনোদিন কয়রা বা সাতক্ষীরায় যাবে না। কয়রা বা সাতক্ষীরাতে যে বাঘটা আছে সে সুন্দরবনে আসবে না। এক টেরিটোরির বাঘ অন্য টেরিটোরিতে গেলে মারামারি হবে। এটাকে বলে টেরিটোরি ফাইট। বাঘ যার যার টেরিটোরিতে একাই থাকে।’
তিনি বলেন, ‘২০০৫ সালের একটা গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনে একটা বাঘিনীর টেরিটোরি হলো ১৫-১৭ বর্গ কিলোমিটার। এই এলাকায় দুই-তিনটা বাঘিনী থাকবে। কিন্তু বাঘ থাকবে একটাই। আরেকটা শক্তিশালী বাঘ এখানে আসলে ফাইট হবে। এখানে প্রথমটা পরাস্ত বা আহত হলে আরেকটা আসবে। পশ্চিমবঙ্গে যে বাঘগুলো আছে তারও টেরিটোরি আছে।’
আবু নাসের মহসিন বলেন, ‘মূল বিষয়টা হলো ধারণক্ষমতা কতটুকু? টেরিটোরি অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০০ থেকে ২২০টি বাঘের ধারণক্ষমতা আছে। ২০১৮ সালে সুন্দরবন জলদস্যুমুক্ত হয়েছে। অনেক জলদস্যু আত্মসমর্পণ করেছে। কেউ কেউ মারা গেছে। এখন সুন্দরবনে একজন ডাকাতও নেই। এই কারণে বোঝা যাচ্ছে, সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ বেড়েছে। আমরা এবছর বাঘ জরিপ করবো। তখন দেখা যাবে, বাঘের সংখ্যা কত বেড়েছে। ২০১৮ সালের বাঘ জরিপে ১১৪টি বাঘ পাওয়া গেছে। এরপর গত চার বছর যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে ধারণা করছি হরিণের সংখ্যা বেড়েছে, বাঘের সংখ্যাও বেড়েছে। পর্যটকরা এখন সুন্দরবনে গেলে পর্যাপ্ত হরিণ দেখতে পান। চার-পাঁচটি বাঘ একত্রে দেখেছেন পর্যটকরা। ২০২২ সালের জরিপে বাঘ বাড়বে বলে আশা করছি। কেউ যদি বলে বাংলাদেশের বাঘ পশ্চিমবঙ্গে যায়, আর পশ্চিমবঙ্গের বাঘ বাংলাদেশে আসে, এটি কোনোদিনই সম্ভব নয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সীমানায় রায়মঙ্গল নদী আছে। এই নদীতে কোথাও কোথাও বাঘ এপাশ-ওপাশ করে। কিন্তু তারা ওই টেরিটোরির মধ্যেই থাকে, এর বাইরে যায় না।’
তিনি বলেন, ‘রেকর্ড আছে দুটি বাঘ ২০১১ ও ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশের হলদিবুনিয়া চলে এসেছিল। যা পশ্চিমবঙ্গের গবেষকরা স্যাটেলাইটে দেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাঘ পশ্চিমবঙ্গে গেছে, এমন নজির নেই।’
গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় গন্ডার সংরক্ষণ ও গন্ডার শুমারি সংক্রান্ত পুরনো আইন প্রত্যাহার বিষয়ে বলতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক দাবি করেছেন, ‘খাদ্যের অভাবে সম্প্রতি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ থেকে অনেক বাঘ ভারতে এসেছে। এই সংখ্যা ১২৩টির মতো। অন্তত ২৭টি রয়েল বেঙ্গল টাইগার বেড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শুমারিতে এই সংখ্যা ছিল ৯৬। জঙ্গলে খাবারের টান ধরলেই বাঘ গ্রামে ঢুকে পড়ে। এজন্য বাঘ নিয়ে মাস্টারপ্ল্যানের নির্দেশ দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার কড়া নির্দেশে নৌকায় করে হরিণ ও শূকর নিয়মিত গভীর জঙ্গলে ছেড়ে আসায় এই সাফল্য।’