প্রতিবাদের ভাষা!

বাংলাদেশের রাজনীতির গত তিন দশক নিজ চোখে খুব কাছ থেকে দেখা। ব্যক্তিগত জীবনে আমি আওয়ামী সমর্থক হলেও প্রায়শই আওয়ামী লীগের সমালোচনাই করেছি। আমি মনে করি গঠনমূলক সমালোচনা এক ধরণের শিল্প, যা আদতে বিরোধী দলের করা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা কখনোই হয়ে উঠে না, তা যে দলই হোক।

গত তিন দশকে মাত্র একবারই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছে এবং তা ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ করেছে। ৯৬ বা ২০০৬ সালের ঘটনা আমাদের সবার জানা, বিএনপি চক্রান্ত করে কিভাবে ক্ষমতার দখল নিতে চেয়েছে তা আমরা সবাই জানি, সে বিষয়ে আলোচনায় যাবো না, কারণ A দল বলেন আর B দল বল, সবাই ক্ষমতা চায়, তা যেভাবেই হোক। Birds Eye View (নাকি Drone Camera View বলবো) তে দেখলে এ দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা খুবই নিম্নমানের।


অনেক সুশীলের মতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন পথ খোলা নেই, বিএনপি একই দাবীতে নির্বাচন বর্জন করছে। এখানে আমি প্রশ্ন করতে পারি, বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার ক্ষমতাকালীন কি করেছে? প্রতিবারই তো আওয়ামী লীগ জোর করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছে। এ সব আন্দোলন তো চোখের দেখা।


এ দেশে যে দলই ক্ষমতায় যায় তারা একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে উৎসাহী হয়ে উঠে। ক্ষমতা বড়ই অদ্ভুত জিনিস, আমরা জানি, Power tends to corrupt, and absolute power corrupts absolutely. এই এবস্যুলুট পাওয়ার আমার কখনোই পছন্দ নয়। বর্তমানে গণতন্ত্রের নামে তৃতীয় বিশ্ব তো অবশ্যই, এমনকি উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র চলছে। শব্দটি মনে রাখুন, ‘গণতান্ত্রিক-একনায়কতন্ত্র’।

ব্যক্তিগতভাবে আমি অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর গণতন্ত্রে বিশ্বাসী নই, কারণ এখানে এটা একটা ফ্যালাসি তন্ত্র মাত্র। জাহাজের ক্যাপ্টেন নির্বাচনে যদি গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন হয়, আর সেখানে সালমান বা শাহরুখ খান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তবে বিপুল ভোটে পাশ করবেন, কিন্তু তারা জাহাজের ব্যাপারে কিছুই জানেন না। বাংলাদেশের ব্যাপারেও হয়েছে তাই। আমরা যাকে ইচ্ছা সংসদে পাঠাচ্ছি, যাকে ইচ্ছা মন্ত্রী মিনিস্টার বানাচ্ছি, ব্যক্তি আদৌ যোগ্য কি না সে দিকে আমাদের নজর নেই। ব্যক্তি কতটুকু দলের প্রধানের প্রতি আনুগত্যশীল তাই যেন এখানে যোগ্যতা। এই ধরনের গণতান্ত্রিক চর্চা দেশ ও জনগণের জন্য ক্ষতিকর।

অনেক সুশীলের মতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের কোন পথ খোলা নেই, বিএনপি একই দাবীতে নির্বাচন বর্জন করছে। এখানে আমি প্রশ্ন করতে পারি, বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তার ক্ষমতাকালীন কি করেছে? প্রতিবারই তো আওয়ামী লীগ জোর করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামিয়েছে। এ সব আন্দোলন তো চোখের দেখা। এখন আওয়ামী লীগ যদি বলে, প্রতিবার তোমায় জোর করে ক্ষমতা থেকে নামাতে হয়, একবার তাহলে আমায় ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেখো! যে খেলা বিএনপি বার বার খেলতে চেয়েছিল, একই খেলায় আওয়ামী লীগের কাছে ধরা খেয়ে গেছে। এ এক অনৈতিক রাজনৈতিক চর্চা। আওয়ামী লীগ হয়তো ভাবছে, বারবার বিএনপি যে গেইম প্লান করে তা আমি করলে দোষ কি! আর আমরা ক্ষমতা ছাড়লে আগামীতে বিএনপি যে সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে তারই বা গ্যারান্টি কি!

বিএনপি নির্বাচনে আসবে না, আওয়ামী লীগ খারাপ, প্রতিবাদ করা প্রয়োজন, তাই হিরো আলমকে জয়ী করে সংসদ সদস্য করতে হবে। এই যদি প্রতিবাদের ভাষা হয় তবে আমি দুঃখিত। একটা গল্প বলি, বাঘ আর সিংহের দ্বন্দ্বে অতিষ্ঠ জঙ্গলবাসী ছাগলকে ভোটে নির্বাচন করে সিংহাসনে বসালো। ছাগল তো সর্বভুক, সিংহাসনে বসে এখানে মুখ দেয়, ওখানে মুখ দেয়… এটা চাবায় ওটা চাবায়, কাজের কাজ কিছুই করে না। বিরক্ত হয়ে আবার নির্বাচন দেয়া হল, নির্বাচনের জোগাড় চলছে… একজন বললো, নির্বাচন দিয়ে কাকে কোথায় বসাবেন, ছাগল তো সিংহাসনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে!

চাই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা যদি গঠনমূলক না হয়ে প্রতিহিংসামূলক হয় তবে তা মেনে নিতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক পর্যালোচনায় আমার মনে হয়েছে, বিএনপি যে খেলা বারবার খেলতে চেয়েছে সেই খেলায় সে নিজেই ফেঁসে হয়ে গেছে।

বিএনপির রাজপথের রাজনীতির ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত, তাই রাজপথ থেকে উঠে আসা নেতানেত্রীও হাতেগোনা। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে আওয়ামী লীগও একই পথে হাটছে। আমি প্রায়ই বলি, রাজপথ নেতা উপহার দেয়, ক্ষমতা পদলেহনকারী কুকুর। বিগত এক যুগ সময়ে নেতৃত্বের কারখানা আওয়ামী লীগে কতজন নেতৃত্ব দেয়ার মত চরিত্র তৈরি হয়েছে তা গবেষণার বিষয়।

আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে যারা হিরো আলমকে প্রমোট করছেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, বিবেকবুদ্ধি দিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষণের, আবেগ বা প্রতিহিংসা দিয়ে নয়।

বাবার বলা কথা দিয়ে শেষ করি, ‘বাগানে ছাগল ঢুকতে দিস না রে, যেখানে মুখ দেবে তা বিনষ্ট করে দিবে!’

  • ডা. এনামুল হক। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।