নেতৃত্ব পর্যায়ে সংবেদনশীলতা, বিজেপির শিক্ষা

৩৫ কোটি জনসংখ্যার ভারতে ১৩ শতাংশের বেশি লোক মুসলিম ধরে নিলে দেশটিতে কেবল মুসলমানদের সংখ্যাই প্রায় ১৮ কোটি কিংবা এরচেয়েও বেশি। সংখ্যার এই হিসাব এদিক-ওদিক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোক কম নয়। এমনকি এটা অনেক মুসলিমপ্রধান দেশের চাইতেও বেশি। ধর্মীয় কূটনৈতিক-সম্পর্কে নেই কোন দেশ, ভারতও নেই স্বাভাবিকভাবেই। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে দেশটির সম্পর্ক, অন্যদেরও তাই।

ধর্মভিত্তিক দল বিজেপি ক্ষমতায়। দেশে-দেশে এমন দল আছে, বাংলাদেশেও আছে। বিজেপির এই শাসনামলে ভারতে ধর্মান্ধতা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। নরেন্দ্র মোদির বিজেপির ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর, বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর হামলার অনেক ঘটনা ঘটেছে; গরু রক্ষার নামে বেশ কয়েকজন মুসলমানকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওগুলো দেশটির অভ্যন্তরসহ এই অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ঐতিহাসিক ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতের এই অবস্থা ক্ষমতাসীনদের ধর্মীয় রাজনীতির কারণে যে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতে করে ধর্মীয় সহাবস্থান অনেক জায়গায় দুর্বল হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত ভারত উৎরে যাবে মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা ওখানে আছে বলে।


নবী মোহাম্মদের অপমানে যদি কারও মন কাঁদে এখানে স্ব-স্ব পর্যায়ে প্রতিবাদ করতে পারেন, নিন্দা জানাতে পারেন; তবে ব্যক্তি পর্যায়ের এই প্রতিবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রকে যুক্ত করার দরকার পড়ে না। মাঠগরমের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে বাধ্য করাতে গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাঘাত ঘটতে পারে, সাম্প্রদায়িক হিংসার চাষ হতে পারে, সহাবস্থানের সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ভিনদেশের ঘটনায় উত্তপ্ত হতে পারে বাংলাদেশ। আমরা কেন যাবো ওই পথে?


নিকট অতীতে বিচ্ছিন্ন ধর্মান্ধতার প্রকাশের বাইরে বিজেপির দুই নেতার সাম্প্রতিক বক্তব্য কেবল এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এর বৈশ্বিক রূপ পাওয়ার অপেক্ষা এখন। উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো প্রবল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ওআইসিও। খোদ ভারতেও এই মন্তব্যের প্রতিবাদ হয়েছে, দেশটির কেবল ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাই নয়, হিন্দু ধর্মের অনেক শীর্ষ-ব্যক্তিত্বরাও এর প্রতিবাদ করেছেন।

নবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) নিয়ে বিজেপির নূপুর শর্মার অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্যের পর তার দলীয় সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। তিনি তার বক্তব্য প্রত্যাহার করে এজন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। একই বিষয়ে অপর এক কটূক্তিকারীকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, পুলিশও গ্রেপ্তার করেছে তাকে। অর্থাৎ বৈশ্বিক কিংবা উপসাগরীয় দেশগুলোর চাপে পড়ে হোক কিংবা নৈতিক কারণেই হোক ক্ষমতাসীন সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে।

ইসলাম ধর্মের শেষ নবীকে নিয়ে ভারতের দুই নেতার বক্তব্যকে দেশটির রাষ্ট্রীয় বক্তব্য বলে ধরে নেওয়ার কারণ কি আছে? নিশ্চয়ই নয়। নূপুর শর্মারা ক্ষমতাসীন দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতা হতে পারেন, কিন্তু তাদের বক্তব্যকে ভারত রাষ্ট্রের বক্তব্য বলে মনে করার কারণ নাই। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ও আইনি ব্যবস্থা এর বড় প্রমাণও হতে পারে। তাই এই ইস্যু নিয়ে আমাদের দেশে উত্তেজনা সৃষ্টির অবকাশ নেই।

নবী মোহাম্মদের বিরুদ্ধে কটূক্তির প্রতিবাদকে অনেকে ‘ঈমানি দায়িত্ব’ বলছেন। এই ঈমানি দায়িত্বের সঙ্গে যখন পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়াসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ-নিন্দার দাবি ওঠে তখন এটা আর ঈমানি দায়িত্বের পর্যায়ে থাকে না। হয়ে যায় রাজনৈতিক হাতিয়ার। দুঃখজনক বাস্তবতা বর্তমানে বাংলাদেশে সে প্রক্রিয়াই চলছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ফাঁদে পা দিতে বসেছে মুসল্লিরা। তাই শুক্রবার বাদ জুমার পর সারাদেশে যে বিক্ষোভ হয়েছে সেখানে ওঠে এসেছে পণ্য বর্জনের রাজনৈতিক দাবি।

মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে এক দেশের পণ্য অন্য দেশ কি সহজে বর্জন করতে পারে? কঠিন কাজ, অসম্ভবের পর্যায়েও পড়ে। এখানে পণ্য বর্জনের ডাককে উত্তেজনা সৃষ্টির রাজনীতি বলেই ধারণা করা যায়। কারণ পণ্য বর্জন যাদের মুখ থেকেই শোনা যায় তাদের বেশিরভাগই নেতাগোত্রীয়। মাঠগরমের বক্তৃতা আর ভারত-কার্ডই মূলধন তাদের, ধর্ম ও নবী অবমাননা স্রেফ উপলক্ষ! বাজার ব্যবস্থা বলছে, অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা ভারত নির্ভরশীল। কিছু ক্ষেত্রে অতি-নির্ভরশীল। একটা মাত্র উদাহরণ দিই—পেঁয়াজের ফলন নিয়ে যতই আলোচনা হোক না কেন স্থলবন্দরে তিনদিন আমদানি বন্ধ হলে বাজার ব্যবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, নিকট অতীতেই আমরা টের পেয়েছি। কেবল কি পেঁয়াজ? নিত্যপণ্যসহ কী বাদ নেই ওই তালিকায়! শহর কিংবা গ্রামে নিজেদের কিংবা পাঠাও-উবারের যে মোটরসাইকেলে চড়ছেন সেটা কি হুট করে বর্জন সম্ভব? যে স্মার্টফোন, ফিচার ফোন ব্যবহার করছি-করছেন তার একটা বড় সংখ্যাও পড়ে যায় ওই বর্জনের তালিকায়। সামনে কোরবানির ঈদ। গোরু-ছাগলে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ যতই বলা হোক না কেন ভারত থেকে বৈধ কিংবা অবৈধ যে পথেই আসুক না কেন ওটা না হলে বাজারে গোরু নয় গোরুর রশি ধরে টানাটানি লেগে যায়! কোরবানির যে চামড়া যাবে মাদ্রাসা-মাদ্রাসা-এতিমখানায় সেখানে কোনটা দেশীয় গোরু আর কোনটা ভারতীয় গোরু যে যাচাইবাছাইয়েও যাবেন কেউ?

নবী মোহাম্মদের অপমানে যদি কারও মন কাঁদে এখানে স্ব-স্ব পর্যায়ে প্রতিবাদ করতে পারেন, নিন্দা জানাতে পারেন; তবে ব্যক্তি পর্যায়ের এই প্রতিবাদের সঙ্গে রাষ্ট্রকে যুক্ত করার দরকার পড়ে না। মাঠগরমের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে বাধ্য করাতে গেলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাঘাত ঘটতে পারে, সাম্প্রদায়িক হিংসার চাষ হতে পারে, সহাবস্থানের সমাজ প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ভিনদেশের ঘটনায় উত্তপ্ত হতে পারে বাংলাদেশ। আমরা কেন যাবো ওই পথে?

ভারতকে বর্জন করা, ভারতীয় পণ্য বর্জন নিয়ে সামাজিক মাধ্যম উত্তপ্ত। ওখানে অনেককে বলতে দেখছি, কাতার বিশ্বকাপে ভারতীয়দের টিকিট দেবে না দেশটি। যতটুকু জানি তাতে বলি, ফিফা বেচে বিশ্বকাপের টিকেট, আয়োজক দেশ নয়। ফিফা ভারতীয়দের ক্ষেত্রে এমন বিধিনিষেধ দিয়েছে বলেও শুনিনি। তথ্যের সত্যতা খুঁজলাম অনেক জায়গায়। পাইনি কোথাও। এটা তো খেলার বিষয়, এবার আসি ধর্মীয় বিষয়—জুলাই মাসে পালিত হবে হজ। সারাবিশ্বের ১০ লাখ লোক সৌদি আরবে যাবেন হজব্রত পালন করতে। দেশটির হজ ও ওমরাহ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবার যে কোটা নির্ধারণ করেছে তাতে ভারতের অবস্থান তৃতীয়। ভারতের ৭৯ হাজার ২৩৭ জনকে এবার হজ করার সুযোগ দিচ্ছে সৌদি আরব। এখানে ভারতীয়দের বর্জন করছে না দেশটি। তাহলে আপনাদের এই বর্জনের ডাক টেকে যুক্তিতে?

ধর্মীয় বিষয়সহ নানা বিষয়ে সংবেদনশীলতা চর্চা জরুরি। নেতৃত্ব পর্যায়ে থাকা লোকদের আরও বেশি জরুরি। বিজেপি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। এর ব্যর্থতার খেসারৎ দিতে বসেছে তারা। ভারতের ঘটনায় ধর্মীয় মূল্যবোধে আবিষ্ট বাংলাদেশের লোকজন প্রতিবাদ-নিন্দা করতেই পারে; এখানে সরকার বাধা দিচ্ছে না। কর্মসূচিগুলো যাতে ধর্মীয় মূল্যবোধের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ থাকে!

  • কবির য়াহমদ। প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডেটুয়েন্টিফোরডটকম।

মুক্তকথন বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, লেখার বিস্তারিত ও মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। এর সাথে sylhetvoice.com এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে; সর্বক্ষেত্রে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা নেই। লেখকের বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhetvoice.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।