তবে কি নতুন বসন্ত এসে গেছে!

ক’মাস হলো সেই বাতাসটাই বইছে চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে। মহামারির দীর্ঘ দমবন্ধ সময় কেটে সুবাতাসের শুরুটা হয় রোজার ঈদে। সেসময় মুক্তি পায় শাকিব খানের দুটি ছবি ‘বিদ্রোহী’ ও ‘গলুই’। সঙ্গে ছিল ‘শান’, নায়ক ছিলেন সিয়াম আহমেদ।

সবাইকে চমকে দিয়ে প্রথম দুটিকে পাশ কাটিয়ে বেশ প্রশংসা পায় তৃতীয় ছবিটি। বলা যায়, রোজার ঈদটা ছিল দিনবদলের ইঙ্গিত। কারণ, ঢালিউড কিংয়ের জোড়া আঘাতের বিপরীতে তরুণ নায়ক সিয়াম ও অভিষেক নির্মাতা এম রাহিম যেন একাই লড়াইটা জমিয়ে দিলেন! ছড়িয়ে দিলেন নতুন বসন্তের সৌরভ। যা ঢালিউডের দুই দশকের ইতিহাসে কেউ ভাবেনি।

রোজার ঈদের রেশ আরও তুমুল গতিতে বইলো কোরবানির ঈদে। ঢালিউড বা সিনেপ্রেমিরা যেন খুঁজে পেলো পূর্ণতা। প্রেক্ষাগৃহে নামলো দর্শক ঢল। সিনেমার তরুণ তুর্কিরা বুঝি জমিয়ে ফেললো সিনেমাহলের চৌকাঠ। দর্শকরা হয়েছে হলমুখী, প্রযোজকরাও লগ্নি ফেরত পাচ্ছে অনেক বেশি।

কোরবানির ঈদে মুক্তি পায় তিনটি চলচ্চিত্র। এরমধ্যে সর্বাধিক প্রেক্ষাগৃহ পায় অনন্ত জলিলের ‘দিন দ্য ডে’। মুক্তি পায় অনন্য মামুন পরিচালিত ‘সাইকো’ ও রায়হান রাফীর ‘পরাণ’। শুরুতে তিনটি ছবিই হলে প্রচুর দর্শক টানে।

তবে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সামনের কাতারে চলে আসে ‘পরাণ’। যা এখন সুপারহিট ছবি। তুমুল প্রশংসিত হন এর নায়ক শরিফুল রাজ। স্তুতি বাক্য মিলেছে নায়িকা বিদ্যা সিনহার পক্ষেও।

ছবিটির পরিচালক রায়হান রাফী মনে করেন, গল্প ও নির্মাণই হলো মূল। আর এ কারণেই রাজের মতো নতুন মুখও কাঁপিয়ে দিয়েছেন ঈদ উৎসব।

‘‘এখন আমাদের উচিত আরও ভালো কিছু নির্মাণ সামনে আনা। কারণ ‘পরাণ’র পরই ঊর্ধ্বমুখী সিনেমার হাল ধরেছে ‘হাওয়া’। ইতোমধ্যে মধ্যবিত্তরা আবারও হলে ফিরতে শুরু করেছে। এখন যদি দর্শকদের হলে ধরে রাখতে হয় তাহলে ভালো ছবির ধারাবাহিকতা খুব দরকার।’- বললেন সময়ের সফল নির্মাতা রায়হান রাফী।

‘পরাণ’ মুক্তির তৃতীয় সপ্তাহে ২৯ জুলাই আসে ‘হাওয়া’। শুরুতেই পায় তুমুল দর্শকপ্রিয়তা। সেখানে আবারও হাজির হন রাজ। মুন্সিয়ানা দেখান চঞ্চল চৌধুরী, নাজিফা তুষিরাও। ছবিটি পরিচালনা করেন বিজ্ঞাপন নির্মাতা মেজবাউর রহমান সুমন।

দেশের সবচেয়ে আধুনিক চেইন প্রেক্ষাগৃহ স্টার সিনেপ্লেক্সে এটি প্রথম সপ্তাহে একসঙ্গে রোজ ২৬টি শো প্রদর্শন করে। প্রেক্ষাগৃহটির জ্যেষ্ঠ বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিনের মতে, সিনেপ্লেক্স থেকেই বড় ধরনের লগ্নি তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে ‘পরাণ’ ও ‘হাওয়া’। যা প্রযোজকদের আশা দেখাচ্ছে।

তবে কোরবানির ঈদের শুরুতে এতটা আশাবাদী ছিল না কেউই। বিশেষ করে গত দুই দশক ধরে ঢাকাই চলচ্চিত্র নেতৃত্ব দেওয়া শাকিব খানহীন ঈদটা সাদামাটাই যাবে বলে অনেকেই নিচু গলায় কথা বলেছিলেন।

কিন্তু শীর্ষ নায়কের অনুপস্থিতি বুঝতেই দেয়নি ‘নন কমার্শিয়াল’ শিল্পীরা!

সিনেমা হল মালিক বা প্রদর্শক সমিতির উপদেষ্টা ও সিনেমা হলমালিক মিয়া আলাউদ্দিন মনে করেন, এখানে শিল্পী কোনও বিষয় নয়, নির্মাণটাই আসল।

তার মতে, ‘কমার্শিয়াল নায়ক না হওয়াতেই ভালো হয়েছে। নতুনদের পরিচালক ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পেরেছেন। আর দর্শকরাও নতুন কিছু পেয়েছেন। তবে শাকিব খানের অবদানটিও মনে রাখতে হবে। পুরনোদের পাশে নতুনদেরও এভাবে কাজ করতে হবে।’

প্রশংসাও করেন শিল্পীদের। বলেন, ‘‘চঞ্চল চৌধুরী তো ধারণাতীতভাবে এগিয়েছেন। তার ‘মনপুরা’তে আমরা ব্যবসা করেছিলাম। ‘আয়নাবাজি’ ও ‘দেবী’তেও তিনি অনবদ্য। আর ‘হাওয়া’ তো নতুন মাত্রা দিলো। আবার ‘পরাণ’র ছেলেটাও (রাজ) ভালো করেছে।’’

তবে এত কিছুর পরও চলচ্চিত্রের সুদিন এসেছে বলে মনে করেন না বর্ষীয়ান এই চলচ্চিত্র বিপণনবোদ্ধা। এটাকে সাময়িক স্বস্তি হিসেবে দেখছেন তিনি।

অন্যদিকে, এটাকে সুদিন বলেই অভিহিত করলেন প্রযোজক ও পরিচালক মুশফিকুর রহমান গুলজার। তার ভাষ্য, ‘চলচ্চিত্রের সুদিন চলে এসেছে। সিনেমার পক্ষে এখন একটা হাওয়া বইছে। নতুনরা নির্মাতাদের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করেছেন। আগে দেখা যেত শীর্ষনায়ক ছাড়া প্রযোজকরা ভাবতে পারতেন না। এখন স্বল্প বাজেটে সেটা ভাবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তাই বিগ বাজেটের যেমন ছবি হবে তেমনি থাকবে স্বল্প বাজেটও। চলচ্চিত্রে বিনিয়োগটা আরও বাড়বে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, সিনেমাহলের প্রাণ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তাদেরকেও নিয়মিতভাবে গত দুই মাসে প্রেক্ষাগৃহে আসতে দেখা গেছে। এখন দরকার ভালো গল্প ও নির্মাণের আরও কিছু চলচ্চিত্র। খোঁজ নিয়ে মিলেছে সেই তালিকাটাও। জানা গেছে, চলতি বছরে মুক্তির মিছিলে থাকা বেশিরভাগ ছবিই মানসম্মত। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রায়হান রাফীর ‘দামাল’, দীপংকর দীপনের ‘অপারেশন সুন্দরবন’, সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের ‘ব্ল্যাক ওয়ার’, আবু রায়হান জুয়েলের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন’, মাহমুদ দিদারের ‘বিউটি সার্কাস’, শাকিব খানের ‘আমিই বাংলাদেশ প্রভৃতি।