জুলাইজুড়ে থাকছে লোডশেডিং

কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারাদেশে লোডশেডিং চরম আকার ধারণ করেছে। ফলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি শিল্পকারখানায় উৎপাদনের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তবে লোডশেডিংয়ের সমস্যা এ মাসেই শেষ হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র। দেশ বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর প্রথমবারের মতো লোডশেডিংয়ের সম্মুখীন হওয়ায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রাপ্ত তথ্য বলছে, দেশের উত্তরাঞ্চল রাজশাহী, রংপুরসহ কয়েকটি জেলায় ছয় থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম বরিশাল, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে এক হাজার ৪০০ থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার এক মেগাওয়াট।

প্রয়োজনের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা থাকার পরও কেন এত লোডশেডিং- জানতে চাইলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকদিন ধরে দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং অনেক বেড়ে গেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বিদ্যুৎ উৎপাদনে চাহিদা অনুযায়ী পিডিবিকে গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না। ফলে চাহিদার চেয়ে গড়ে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে।

চাহিদা অনুযায়ী, বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না পারায় সারাদেশে লোডশেডিং শুরু হয়েছে। দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে দিনের একটি সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছে না কোম্পানিগুলো। ফলে সেসব এলাকায় ভোগান্তিও তীব্র হচ্ছে।

পল্লীবিদ্যুতের রাজশাহী অফিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী লোডশেডিংয়ের কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, তার অধীনে থাকা পল্লীবিদ্যুতের ছয়টি সমিতির প্রতিটিতে ১০ থেকে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছে। ফলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে।

বিপিডিবি সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সারাদেশে দিনের বেলা বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ও সন্ধ্যায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট। এর আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১৩ হাজার ৭০ মেগাওয়াট, কিন্তু সেদিন সারাদেশে উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ১ মেগাওয়াট। সারাদেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিল এক হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। আর ঘাটতি বিদ্যুতের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দৈনিক চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং হচ্ছে।

বিদ্যুতের চলমান লোডশেডিং বৈশ্বিক সমস্যা উল্লেখ করে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘সরকার বিপুল অংকের টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এখন যে সংকট, সেটা মোকাবেলা করতে পৃথিবীর অনেক দেশই হিমশিম খাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের দেশীয় গ্যাসের যে জোগান সেখানে প্রেসার কমে গেছে। সেটা বাড়লে সংকট কিছুটা কমবে। এছাড়া তিন-চারগুন বেশি মূল্য দিয়ে এলএনজি কিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। এজন্য অপেক্ষা করতে হবে আগস্টে শুরু হওয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে। কয়লাভিত্তিক প্রকল্প শুরু হলে এই সমস্যা সমাধান হবে।

বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পর হঠাৎ লোডশেডিংয়ের কারণ জানিয়ে পাওয়ার সেলের এই মহাপরিচালক বলেন, ‘সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র্র করে বিশ্ববাজারে জ্বালানির সংকট তৈরি হয়েছে। এই সময়ে দফায় দফায় বেড়েছে জ্বালানির দাম, এই সংকটই আমরা গত কয়েকদিন ধরে মোকাবেলা করছি। কিন্তু জাপানের মতো উন্নত রাষ্ট্র দুই মাস আগে থেকে বিদ্যুতের সংকট মোকাবেলা করছে। লোডশেডিং সমস্যায় পড়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেপালও।’

মোহাম্মদ হোসাইন আরও বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে আমাদের যে পরিমাণ গ্যাসের প্রয়োজন, তার ৫০ শতাংশ আমরা জোগান দিতে পারি। বাকি ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আর এতেই বছরে ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দিতে হয়। বর্তমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে হলে জ্বালানি তেল ও এলএনজিতে অন্তত চার থেকে পাঁচগুন ভর্তুকি দিতে হবে। ভর্তুকি দেওয়া বিদ্যুৎ খাতে আরও চারগুণ ভর্তুকি দেওয়া সরকারের পক্ষে অসম্ভব। এলএনজির অস্বাভাবিক দর বাড়ার কারণে দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি হচ্ছে।’

বিদ্যুতের চলমান লোডশেডিংয়ে যে সংকট চলছে সেটিকে বড় বিপর্যয় বলতে নারাজ ডিপিডিসির পরিচালক বিকাশ দেওয়ান। সংস্থাটির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমি মনে করি না এটা বড় কোনো বিপর্যয়। আপনারা জানেন এলপিজির দাম দফায় দফায় বেড়ে গেছে এবং সেটা শুধু আমাদের দেশে না, বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। পাশের দেশগুলোর দিকে তাকান, ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, দিল্লী, বেঙ্গালুরুতে ইতিমধ্যে বিদ্যুতের ব্যবহার সীমিত হয়েছে।’

বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘সরকার যেহেতু শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে। জনগণ ভোগান্তিতে পড়ুক এটা কোনোভাবেই চাইবে না। আমরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হলেই কিন্তু সমস্যাগুলো মিটে যায়। শহরের একটি বড় অংশের মানুষ তিন, চার বা পাঁচটি এসি ব্যবহার করে। এ ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এসি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া দরকার।’

বিদ্যুতে সরকারের ভর্তুকির বিষয়ে বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সরকার বিপুল অংকের ভর্তুকি দিচ্ছে এবং সেটা অব্যাহত রয়েছে। এক ইউনিট বিদ্যুৎ তৈরি করতে খরচ পড়ে ১২ টাকা, আর সেই বিদ্যুৎ ৬ থেকে ৭ টাকা ইউনিট বিক্রি করছে। সেখানে অর্ধেকই ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। সেটা অব্যাহত আছে।’

লোডশেডিংয়ে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে জরুরি প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। সেগুলোতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ থাকবে। তারপরও আমাদের অনুরোধ থাকবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার।’

তবে সংকট কবে নাগাদ শেষ হবে এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারছেন না তিনি।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০২০ সালে সরকার ৪ থেকে ৬ মার্কিন ডলার প্রতি ইউনিট দরে গ্যাস বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করেছে। সেই একই গ্যাসের প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছে ৩৮ ডলার। আর স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশ কিনছে ২৫ ডলারে। ফলে বিশাল এক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। এই হারে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব বলে মনে করছে সরকার।